(llbangla.org)
তেরিজা হাইতারের পুস্তক ‘দি ক্রিয়েশন অব পবার্টি’ ১৯৮১ সালের বিশ্ব ব্যাংকের ব্রেন্ডিট রবার্টের একটি প্রতিবেদন কে কেন্দ্র করে লিখিত হয় এবং সেই বছরই তা প্রকাশ করা হয়। এই বইটি বিগত কয়েক দশকে ও তার আবেদন হারায়নি। এতে ধনী দেশ ও গরীব দেশ সমূহের আর্থনৈতিক পরিস্থিতি যে ভাবে তুলেধরা হয়েছিলো তা আজো বিদ্যমান। বিশেষ করে হাইতার প্রথম বিশ্ববাদের যে চিত্র অংকন করেছিলেনতা এখন দিবালোকের মত স্পস্ট। কোন কোন ক্ষেত্রে হাইতারের বক্তব্যের কিছু ব্যাতিক্রম হলে ও তার উপস্থাপিত বক্তব্য রাজনৈতিক ক্ষেত্রে শতভাগ সঠিক। তার রচনাটি স্বাধীনতা তত্ত্বে বিশ্বাসী তাত্ত্বিকদের কার্যক্রমে সবিশেষ সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। তেরিজার রচনাকে আমরা লিখক ওয়াল্টার রডনি, সামির আমীন ও এন্দ্রো গান্ডার ফ্রাঙ্কের সাথে তুলনা করতে পারি। তেরিজার এই বইয়ের প্রথম খন্ডে দেশ সমূহের মাঝে যে বৈষম্য বিদ্যমান যা পুঁজিবাদ বিকাশের সূচনায় এবং ইউরূপীয় সাম্রাজ্যবাদের সময়ে যে পরিস্থিতি ছিলো তা পর্যালোচনা করে আমরা তুলে ধরেছি। হাইতার দেখান যে, ইউরূপীয় উপনিবেশবাদের সময়ে সারা দুনিয়া থেকে সম্পদের পুঞ্জীভবন করে ইউরুপের পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটে। তাই সেই সময় থেকেই পশ্চিম ইউরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য প্রথম বিশ্ববাদি দেশ সমূহ পুঁজিবাদের সূবিধা গ্রহন করে আসছেন। সেই সুবাধেই তাঁরা নিজেদের উন্নয়নের ধারাকে এগিয়ে নেবার পাশা পাশি তৃতীয় বিশ্বকে পিছিয়ে রাখার নীতি গ্রহন করে চলেছে। আমরা তেরিজার পুস্তকটিকে কেন্দ্র করে দুনিয়া ব্যাপী উন্নয়ন ও অপউন্নয়নের বিষয়ে আলোকপাত করব।
উন্নয়ন ও অপউন্নয়ন
হাইতার প্রথম বিশ্ববাদিদের কতিপয় যুক্তিকে সুবিবেচনায় নিয়েছিলেন, যেমন উপনিবেশবাদ একদিকে নির্মম হলে ও অন্যদিকে ইহা পৃথিবীর কতিপয় এলাকাকে অধুনিকতার সাথে যুক্ত করেছিলো। তাদের আরো যুক্তি ছিলো যে সাম্রাজ্যবাদ রাজনীতির সংকৃতিকে উন্নততর করেছে এবং উৎপাদন শক্তিকে করেছে অধিক গতিশীল। কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোতে কার্ল মার্ক্স ঐতিহাসিক বস্তুবাদের আলোকে উপনিবেশবাদকে ব্যাখ্যা করেছেন তবে এই ব্যাখ্যা তার অন্যান্য বিজ্ঞান ভিত্তিক কাজের মত ছিলো নাঃ
“ অ্যামেরিকার আবিস্কার, নতুন নতুন উদ্বভাবন ও নয়া নয়া ভূমির অধিকার গ্রহন উঠতি বুর্জোয়াদের জন্য শক্তিশালী ভিত্তি ভূমি নির্মান করে দিয়েছিলো। ভারতীয় এলাকা, চীনের বাজার, আমেরিকায় উপনিবেশ স্থাপন, উপনিবেশের সাথে বানিজ্য স্থাপন, মানুষ ও পন্যের আদান প্রদান, অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় পুঁজিবাদের বিকাশ দ্রুততর হয়। সামান্তবাদি কাঠামোকে পরিবর্তন করে একটি সামাজিক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করে দেয়।
সামান্তবাদি ধারার শিল্প, সেই শিল্পের একক প্রধান্যতা বর্তমানে নতুন বাজার ব্যবস্থায় গিল্ড প্রথার অবসান করে দিয়েছে। সেখানে মেনুফ্যাক্সারিং ব্যবস্থা সেই স্থান দখল করেছে। গিল্ড মাস্টারগন মেনুফ্যাক্সার মধ্য ভিত্ত শ্রেনীর দ্বারা অপসারিত হয়ে গেছেন; শ্রম বিভাজন হয়েছে ব্যাপক ভাবে। এখন একই কারখানায় নানা ভাবে শ্রম জীবি মানুষ উৎপাদনে যুক্ত হয়েছেন।
ইতিমধ্যে বাজার দিনে দিনে সম্প্রসারন হয়েছে, চাহিদা ও বেড়েছে। চলমান চাহিদা এখন আর মেনুফেক্সারার রাও মেটাতে পারছেন না । তাই, বাস্প ইঞ্জিন শিল্পে এক নতুন বিপ্লব আনয়ন করেছে। ফলে, মেনুফেক্সারারাদের স্থান এখন দখল করেছে বিশাল আকৃতির আধুনিক যন্ত্রপাতি; মধ্যভিত্ত শ্রেনীর স্থান দখল করেছে বড় শিল্পপতি গুষ্টি, শিল্প সৈনিকদের নেতা ও আধুনিক বুর্জোয়া চক্র।
আধুনিক শিল্প কল-কারখানা বিশ্ববাজার গড়ে তুলেছে, এই ক্ষেত্রে অ্যামেরিকার আবিস্কার নয়া দিগন্তের উন্মোচন করে দিয়েছে। এই বাজার ব্যবস্থা ব্যবসা বানিজ্য, পন্যের সঞ্চালন, নানা দেশের আদান প্রদান ব্যাপক ভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে। এই অগ্রগতি, বানিজ্য ও রেলওয়ে স্থাপন ও শিল্প জগতের ব্যাপক সম্প্রসারন ঘটিয়ে দিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে বুর্জোয়াদের পুঁজি বৃদ্বির সাথে সাথে অন্যান্য শ্রেনীর ও অগ্রগতি সাধন সহ মধ্য যুগের অমানিশা থেকে সামনের দিকে মানব সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে”।(১)
প্রথম বিশ্ববাদিরা প্রায়স তাদের সুবিধামত মার্কসের বক্তব্য উদ্বৃত করে থাকেন, বিশেষ করে যখন তৃতীয় বিশ্ববাদের প্রাসঙ্গিকতা উঠলে তখনই তাঁরা তাদের বক্তব্য “প্রমানের” জন্য “সাদা মানুষের বোঝা” কথা গুলো এড়িয়ে যান। মাওসেতুং সহ তেরিজা হাইতার এই প্রসঙ্গে ভিন্নমত পোষন করে থাকেন। মাওয়ের বক্তব্য হলো উপনিবেশবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদ “পিছিয়ে পড়া” দেশ সমূহকে এগিয়ে নেয়নি বরং সাম্রাজ্যবাদ সেই সকল দেশ সমূহকে উন্নয়নের ক্ষেত্রে পঙ্গু ও প্রতিবন্দী করে দিয়েছে। মাওয়ের মতে, সাম্রাজ্যবাদ সমাজের সবচেয়ে পশ্চাতপদ অংশের সাথে যোগসাজস করে কোন দেশে প্রবেশ করে থাকে। একই ভাবে সাম্রাজ্যবাদ তৃতীয় বিশ্বের সমাজ ব্যবস্থাকে তন্দ্রাচ্ছন্ন করে এবং পশ্চাৎপদ করে রেখেছিলো। সাম্রাজ্যবাদী চক্রের মোর্চা প্রায়-সামন্তবাদি অর্থনীতিকে এগিয়ে যেতে দেয়নি এবং জাতীয় পুজির বিকাশ ঘটতে পদে পদে বাঁধা গ্রস্থ করেছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ভারতে ভয়ংকর প্রতিক্রিয়াশীল সামন্তবাদি ও মুৎসুদ্দিকে বাঁচিয়ে রাখে এবং এখান কার উন্নয়ন ধারাকে ব্যাহত করে দেয়।
হাইতার স্পেনের উদাহরন টেনে বলেন, এরা ল্যাটিন আমেরিকায় আধা সামন্তবাদি ধারার অনেক কিছু সেখানে স্থাপন করেছে, যা আগে ছিলো না । সাম্রাজ্যবাদ চীনকে তার নিজস্ব ধারা থেকে বিচ্যুত করেছে এবং তাদের অনুচরদেরকে নানা ভাবে সহায়তা দিয়েছে। এই স্থানীয় অনুচররা হলো পশ্চাৎপদ সামন্তবাদী চক্র ও যুদ্ববাজ গুষ্টি। মাওসেতুংয়ের নয়া গণতন্ত্রের কর্মসূচী হলো সেই অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ। মাও এটা প্রমান করেন যে চীনের বুর্জোয়া শ্রেনি এত দূর্বল যে এদের পক্ষে সামন্তবাদ বিরোধী সংগ্রাম পরিচালনা করা এবং সাম্রাজ্যবাদকে মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, এই কাজ কেবল মাত্র চীনের সর্বহারা শ্রেণী ও তাদের পার্টিই সফল ভাবে সম্পাদন করতে পারেন। আর সেই ঐতিহাসিক কাজ করতে পারে কমিউনিস্ট পার্টি যারা বুর্জোয়াদের সাথে সম্পর্কযুক্ত থেকে ইউরূপে পুঁজিবাদী বিপ্লব সম্পন্ন করবেন, যারা সমাজকে সমাজতন্ত্র থেকে ক্রমে সাম্যবাদের পানে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। (২)
মাওসেতুংয়ের সাথে সূর মিলিয়ে হাইতার বলেন, মানুষের দারিদ্রতার বিষয় বা পিছিয়ে থাকা কোন ভাবে প্রকৃতিক বিষয় নয়। হাইতার এন্ড্রো গান্ডার ফ্রাঙ্ক এর বক্তব্য সমর্থন করে বলেন যে, উন্নয়নশীলতা ও এক প্রকারের উন্ন্যনঃ
“ চলমান উন্নয়নশীলতা ও একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা যা অতীতের অর্থনীতি বর্তমানের স্যাটালাইট অর্থনীতির মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনে ভূমিকা রাখে। এছাড়া একটি দেশের শহরায়ন ও নগরায়নকে এর সাথে সম্পর্কিত করে”। (৩)
তেরিজা হাইতার ওয়াল্টার রডনীর ভাষ্যকে উদ্বৃর করেনঃ
“ উন্নয়ন ও উন্নয়নশীলতা বর্তমান পুঁজিবাদী বিশ্বে বিগত সাড়ে চার শতাব্দি ব্যাপী প্রচলিত আছে। সেই দির্ঘ সময় কাল ধরে আফ্রিকার দেশ সমূহ পশ্চিম ইউরূপকে উন্নয়নের জন্য সুযোগ দিয়ে এসেছে, আবার একেই ভাবে পশ্চিম ইউরূপ আফ্রিকাকে উন্নয়নশীল করার জন্য সাহায্য করে যাচ্ছে”। (৪)
উন্নয়নশীলতা কোন প্রকার প্রকৃতিক দূর্ঘটনা নয়। ইহা সর্ববৈ একটি সাম্রাজ্যবাদী সুপরিকল্পিত বিষয়। সপ্তদশ শতাব্দীর ব্রিটিশ ন্যাভিগেশন আইন টির কথা এখানে বিশেষ ভাবে উদাহরন হিসাবে উল্লেখ করা যায়। সেই সময়ে তাঁরা উপনিবেশে কোন প্রকার শিল্পায়নের পক্ষে ছিলেন না । তাঁরা চায় নাই যে অন্য কোন দেশ তাদের সাথে প্রতিযোগীতায় আসুক। বরং তাদের কাজ ছিলো উপনিবেশীক দেশ সমূহ থেকে কাঁচা মাল সংগ্রহ করে তা দিয়ে উন্নত মানের জিনিস পত্র তৈরী করে আবার উপনিবেশ সমূহে বিক্রি করা। এখানে উল্লেখ্য যে সেই সময়ে ভারতের সকল কাপড়ের কল সমূহ তারা বন্দ্ব করে দিয়েছিলো এবং ভারতীয়দেরকে দিয়ে তাদের কাপড় কেনার জন্য বাধ্য করত। এই নীতি মালা ব্রিটিশরা সারা দুনিয়ায় উপনিবেশিক নীতি মালা হিসাবে গ্রহন করে। অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদিরা নিজেদের অর্থনীতিকে রপ্তানীমূখী রেখে স্থানীয় উৎপাদন বন্দ্ব করে দিয়ে উপনিবেশ সমূহকে আমদানী নির্ভর করে দেয়। হাইতার বর্ননা করেন কিভাবে ব্রিটিশ রাজের লোকেরা ভারতীয় শিল্পকারখানাকে ধ্বংস করে ফেলেঃ
“ ইতিহাসের একটি জগন্য অধ্যায় হলো ব্রিটিশদের দ্বারা ভারতীয়দের শিল্পকে ধ্বংস করে দেয়ার সময়টি। সেই ১৮১৫ সাল থেকে ১৮৩২ সালের মধ্যে রপ্তানী ব্যাপক ভাবে কমে যায়। তা ১.৩ মিলিয়ন পাঊন্ড থেকে নেমে ১ লক্ষ্য পাউন্ডে নেমে যায়। কেবল তাই নয় সেই সময়ে ব্রিটিশরা ভারতে রপ্তানী করে ১৫৬,০০০ পাউন্ড থেকে ৪০০,০০০ পাউন্ড পর্যন্ত। উনিশ শতকের মাঝা মাঝি সময়ে ব্রিটিশদের নিকট থেকে প্রায় এক চতুর্থাংশ সুতা আমদানী করত। কিন্তু ব্রিটিশরা এর উপর নানা প্রকার কর বসিয়ে দিয়ে তা মারাত্মক ভাবে কমিয়ে দেয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো ভারতীয়রা যেন ব্রিটিশদের সাথে বাজারে কোন প্রকার প্রতিযোগিতায় ঠিকতে না পারে। ভারতীয়দের জন্য ব্যবসা বাণিজ্যের দ্বার মারাত্মক ভাবে কঠিন করে দেয়…”(৫)
সাম্রাজ্যবাদী দেশ সমূহ সারা দুনিয়ায় একই রকমের নীতিমালা অনুসরন করে। সত্যিকের অর্থে “মুক্তবানিজ্য” কথাটি মিথ হিসাবেই চলে এসেছে। তবে সাম্রাজ্যবাদী চক্র এই কথাটিকে একটি আওয়াজ হিসাবে ব্যবহার করে পিছিয়ে পড়া দেশের কাছ থেকে ফায়দা হাসিল করেছে । এই পরিস্থিতিতে চীন এক সময় আপিম আমদানী বন্দ্ব করে দিয়েছিলো। ফলে আন্তর্জাতিক মাদক চক্র তাদের উপর প্রচণ্ড ভাবে ক্ষেপে যায়। ১৮৪২ সালে অ্যামেরিকার ৬স্ট প্রেসিডেন্ট জন কুইন্সি অ্যাডামস সাম্রাজ্যবাদী মাদক পাচার কারীদের পক্ষ নিয়ে তাদের ব্যবসা চালু রাখতে সাহায্য করেঃ
“ নৈতিক ভাবে বানিজ্যিক কারনে একটি দেশ অন্য একটি দেশের সাথে মিলে মিশে চলবে তাঁরা পরস্পরকে সামগ্রীক ভাবে সাহায্য সহায়তা করবে, এক জন খ্রীস্টান তার প্রতিবেশীর প্রতি ভালো ব্যবহার করবে… কিন্তু চীন, কোন খ্রীস্টান জাতি নয়… তাদের অন্যদের সাথে সূ প্রতিবেশী সূলভ আচরন করার ক্ষেত্রে কোন প্রকার বাধ্য বাধকতা নেই…এখন এমন একটি সময় বা পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে যা মানুষ প্রকৃতিগত কারনেই রাগান্বিত হয়ে উঠতে পারে [ সেই সময় চীন অপিম কিনতে অস্বীকার করে]… তার যথার্থ কারন বিদ্যমান…”(৬)
১৮৪০ সালে, ব্রিটিশ সেনাবাহিনী চীনে আক্রমন করে বসে। বন্দুকের নলের মাথায় চীনের সরকারকে কয়েকটি চুক্তিতে সই করতে বাধ্য করতে চেয়েছিলো। তারা তথাকথিত বন্দর আইনের আওতায় বিদেশীদের অধিকার রক্ষার নামে শক্তি প্রয়োগ করে। ব্রিটিশরা চীনকে হংকং কে ছেড়ে দিতে, আমদানী শুল্ক কমাতে, এবং তার সাথে সাথে অপিম ব্যবসাকে আইনগত বৈধতা দিতে প্রচণ্ড চাপে ফেলে। পশ্চাৎপদ উপনিবেশ সমূহকে শক্তি প্রয়োগ করে ব্রিটিশদের বাজার সম্প্রসারনে যা যা করার তার সবই করেছে । (৭) বন্দুকের নলের মূখে অন্যদের উপর নিজেদের খেয়াল খুশি চাপিয়ে দেবার কাজ ওরা বার বার তাদের উপনিবেশ সমূহের উপর চাপিয়ে দিয়েছে।
একক পন্য রপ্তানী ভিত্তিক অর্থনীতি
উন্নয়নশীলতা ও এক প্রকার উন্নয়ন, এই ক্ষেত্রে দেখা যায় উন্নয়নশীল দেশ সমূহ তাদের অর্থনীতিকে এগিয়ে নেবার ক্ষেত্রে এক বা একাধীক পন্য রপ্তানী করে থাকে। উপনিবেশিক দেশ গুলো তাদের উৎপাদনের সংখ্যা কমিয়ে কেবল মাত্র একটি পন্যে স্থির হয়ে যায়। এমনকি ফসল ফলানো বা খনিজ সম্পদের ক্ষেত্রে ও একক উৎপাদনে নেমে আসে। নতুন বিশ্বে সমগ্র উপনিবেশেই হয়ত বিশাল চিনি শিল্প বা তামাকে শিল্পে কেন্দ্রীভূত হয়ে গেছে। উপনিবেশের আদিবাসীদেরকে হয় মেরে ফেলা হয়েছে বা তাদেরকে চাপে ফেলে কোণঠাসা করে দেয়া হয়েছে। আদিবাসীদের রেখে যাওয়া ভূমির অপব্যবহার করে ভূমির মান ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। সেইটা ছিলো পরিবেশ বিনাশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঘটনা । হাইতার তার লিখায় জোসে ডি ক্যাস্ট্রোর ভূমি দস্যু রচনার উদ্বৃতি দিয়েছেনঃ
“ আফ্রিকায় স্থানীয় খাদ্য দ্রব্য উৎপাদন মারাত্মক ভাবে কমিয়ে দেয় সাম্রাজ্যবাদী চক্র, তাঁরা নানা জায়গায় কারখানা স্থাপন করে মাটির দূষন ক্ষয় বাড়িয়ে দেয়। তা এখন ও ঘটছে… সেনেগালের বড় বাদাম উৎপাদন পর্যন্ত তাঁরা করতে বাঁধা গ্রস্থ করেছে”। (৮)
অতীতের ধারা বাহিকতা যে এখনও চলছে তা হাইতারের লিখায় ফোটে উঠেছে। তিনি লিখেছেন, কেবল প্রথমিক পন্য নয় বরং অন্যান্য কাঁচা মাল ও ৮১% উৎপাদন কমিয়ে ফেলা হয়েছে। তা বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে “ নিম্ন আয়ের দেশ সমূহে ঘটেছে বেশী”। তেল উৎপাদন কারী দেশসমূহ ছাড়া অন্যান্য দেশ গুলো তাদের বিদেশী আয়ের অর্ধেকের ও বেশী আয় করেন একাধিক পন্য বিদেশে পাঠিয়ে। ৯৪% অর্থ কপার থেকে আয় করে জামবিয়া, ৮৪% আয় করে চিনি থেকে কিঊবা, আর বাদাম এবং বাদাম তেল থেকে ৮৫% আয় করেন করে থাকে গামবীয়া। (৯)
উপনিবেশ সমূহে, যেখানে সাম্রাজ্যবাদ ভূমির উপর দখল নেয়নি, সে সকল স্থানে তাঁরা স্থানীয় জনগণকে বাজারে অধিক মূল্য পাওয়া যায় এমন দ্রব্য উৎপাদনে জড়িত করে । সেই উৎপাদন কিন্তু জনগণের জন্য নয় তা উৎপাদন করে সাম্রজ্যবাদের মুনাফার জন্য। পাশাপাশি ইউরূপীয়ান পন্য আমদানির ব্যবস্থা করে স্থানীয় জনগণের জন্য। কোন কোন সময় জনগণ সাম্রাজ্যবাদের জন্য খাদ্য পন্য উৎপাদনে বা রপ্তানী করতে উৎসাহ বোধ করেন না । যদি এই পরিস্থিতি হয়, যেখানে স্থানীয় জনগণ কঠিন কাজ করতে চায় না, তখন সাম্রজ্যবাদিরা অন্য কোন স্থান থেকে শ্রমিক আমদানী করার চেষ্টা করে থাকে যারা অনেকটাই দাসত্বের জীবন যাপন করে। যদি ও অফিসিয়ালী দাসত্ব নিষিদ্ব হয়ে গেছে কিন্তু বাস্তবে এমন অবস্থার সৃষ্টি করা হয়েছে যেখানে শ্রমিকদের সামনে তেমন কন বিকল্প থাকে না বা স্বাধীনভাবে পেশা নির্বাচন ও করতে পারেন না । সাম্রাজ্যবাদ জনগণকে অর্থকরি ফসল ফলাতে বাধ্য করে, এর উপর নানা জাতীয় কর আরোপ করে শোষন চালায় এবং সামগ্রীক ভাবে ইউরূপীয়ানদের জন্য কাজ করতে জনগণ বাধ্য হয়। অর্থাৎ জনগণের জমি ও সময় নিবেদিত হয় সাম্রাজ্যবাদের জন্য। সকল সক্ষম মানুষ তখন কাজ করে ওদের জন্য। সাম্রাজ্যবাদের আরো একটি বিশেষ কৌশল হলো কোন দেশকে একক কোন অর্থকরী ফসল বা খনিজ দ্রব্য উৎপাদনে ব্যস্ত রাখা যেন তাদের জীবন যাত্রায় বৈচিত্র না আসতে পারে। তা এঁরা আইন গত ও নীতিগত ভাবে রাজি করে দেয়। সেই দেশের জনগণকে অন্য দেশের পন্য কিনতে বাধ্য করে রাখে।(১০) এই অবস্থা কোন কোন সময় সেই জাতির জন্য দূর্ভোগ বয়ে আনে।
“ ইউরূপীয় মেনুফেকচারিং কোম্পানী গুলোর উপর নির্ভরতা বাড়ানোর জন্য কাঁচা মাল সরবরাহের প্রতি অন্যান্য জাতিকে অভ্যস্থ করার সাথে সাথে এবং ক্রমে তাঁরা সেই দেশের জনগণকে কোম্পানী গুলোর উপর নির্ভরশীল করে তুলে। মেনুফেকচারাররা যত স্বনির্ভরাতা অর্জন করে সেই দেশ গুলো তত স্বনির্ভরতা হারায়”।(১১)
“ দুর্ভিক্ষ কেবল অতীতের ঘটনা নয় তা এখন ও চলছে, ভিন্ন রূপে ভিন্ন মাত্রায় এর তিব্রতা আরো বৃদ্বি পেয়েছে। ভারতে এর রূপ নানা ভাবে প্রকাশিত হয়েছে। সেখান মারা গেছেন ১৮০০ জনের ও বেশী মানুশ…(১২)
“ সাধারন ভাবে ও যদি আমরা দেখি যে সামাজিক ভাবে খাদ্য ও অর্থ সহ নানা প্রকার বৈশম্যের কারনে মানুষ সঠিক ভাবে জীবন যাপন করতে পারছে না… সেই বৈশম্য এখন আরো বাড়ছে। উপনিবেশ বাদের ক্ষমতা এখন ভূমির মালিকদের হাতে চলে এসেছে। এশিয়া, আফরিকা ও ল্যাতিন আমেরিকায় নয়া নয়া ভূস্বামী তৈরী হচ্ছে। ভারতের কৃষকেরা ভূস্বামী ও অর্থ লগ্নীকারীদের হাতে বন্দি হয়ে পরেছেন। তাদেরকে বাধ্য করা হয় কম মূল্যে তাদের উৎপাদিত পন্য বিক্রি করার জন্য। সেই ব্যবসায়ী ও অর্থলগ্নী কারী চক্র কম দামে খাদ্য পন্য বিক্রি করে আবারে সেই কৃশকের কাছেই বেশী দামে বিক্রি করে মুনাফা হাতিয়ে নেয়… এই প্রক্রিয়া যে সকল অঞ্চলে চলছে সেই সকল অঞ্চলে সামাজিক বৈষম্য
বেড়েই চলছে। ধনী আরো ধনী এবং গরীব আরো গরীব হচ্ছে”। (১৩)
তেরিজা যদি ও কিউবার কথা উল্লেখ করেছেন কিন্তু তিনি এটা দেখাতে ব্যার্থ হয়েছেন যে, সাবেক সৌভিয়েত ইউনিয়নে ও সেই একেই পরিস্থিতি ছিলো সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের আওতায় সেই একেই কর্ম করেছে সামাজতান্ত্রিক শ্রমিকের দেশ। অর্থাৎ মস্কোর সমন্বয়ে সৌভিয়েত উপনিবেশিক দেশ সমূহ ও কেবল একক পন্য উৎপাদনের সুযোগ পেত। যেমন চিনির রাজ কিউবার কথা বলা যায় । কিউবাকে পাশ্চাত্য ও সৌভিয়েত উভয়ই নিয়ন্ত্রন করতে থাকে । “ বিপ্লবের দশ বছর পর ও কিউবা, যারা বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছিলো তাঁরা ও চিনি উৎপাদনের চক্র থেকে বেড়িয়ে আসতে পারলেন না , দশ মিলিয়ন টন চিনি উৎপাদন করে ও তাদের বিপ্লবের লক্ষ্য দিবা স্বপ্নই রয়ে গেল” (১৪) কেহ কেহ বলেন যে চে গুয়েভারা ও ফিদেল ক্যাস্ত্রোর মধ্যে বিরুধের এটাই প্রধান কারন ছিলো। সকল সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্বে চে র অবস্থান ছিলো সম্পূর্ন বিপরীত। তিনি প্রায়স তৃতীয় বিশ্বে “বহু ভিয়েতনাম সৃষ্টির” আহবান করতেন। চে গুয়েভারা সকল প্রকার সংশধনবাদের বিরুদ্বে কথা বলতেন। তিনি বলতেন আলবেনিয়ার মত কিউবা যেন পরনির্ভরশীল হয়ে না পরে । ক্রুসচেভের আহবানে আওনোয়ার হুজ্জার আলবেনিয়া ফল উৎপাদন করে মনোনবেশ করে পূর্বাঞ্চলের দেশ সমূহে তা সরবরাহ করতে থাকে। মাওবাদি চীন তখন সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদের পথে হাটতে অস্বীকার করে। তাঁরা অন্যের উপর নির্ভরতার নিতি সম্পূর্ন বর্জন করতে থাকে। তাঁরা আত্ম নির্ভরশীল সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন কৌশলকে বুকে ধারন করে দ্রুত এগিয়ে যায়। সাম্যবাদে আমাদের সমাজ ব্যবস্থাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য সমাজতান্ত্রিক পন্থার অন্যতম উদাহরন সৃজন করে মাওবাদ । তাই মাওবাদকে বলা হয় মার্ক্সবাদের তৃতীয় উত্তরণ বা বিকাশের তৃতীয় পর্যায়। চীন সেই সময় পরমানু আস্ত্রের অধিকারী দেশ সমূহের সাথে পাল্লা দিয়ে নিজেকে তাদের সারিতে নিয়ে যায়। ১৯৬৯ সালের চীনের পার্টি কংগ্রেসে লিনপিয়াং যে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন তাতে বলা হয় এখন কার পরিবর্তিন শীল দুনিয়ায় বিপ্লবের প্রবনতাই প্রধান প্রবনাতা। তাই সকল সাম্রাজ্যবাদের বিরুধীতা করে তাদেরকে পরাজিত করে বিপ্লবকে সামনের দিকে আরো এগিয়ে নিতে হবে। মাওবাদ সেই সময়ে বিশ্ব ব্যাপী জন যুদ্বের হাতিয়ার হিসাবে সকল প্রকার সাম্রাজ্যবাদের বিপরীতে নিজেকে হাজির করে। মাওবাদিরা ভাবতেন এখনই সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের চেলা চামুন্ডাদের দিন শেষ হয়ে এসেছে। তাই লিন পিয়াং সকল মাওবাদিকে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্বে এক যোগে আক্রমন করার আহবান করেছিলেন। সাম্রাজ্যবাদকে পতন ঘটিয়ে সাম্যবাদের পথকে প্রসস্থ করতে ডাক দিয়েছিলেন। এটাই হলো বাস্তবতা যে উন্নয়নশীল দেশের নিজস্ব বাজার ও থাকে সিমীত আকারে। তাদের প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র ও কম। তাদের সিমীত পন্য যেমন চা, কপি, চিনি ও রাবার ইত্যাদি। (১৫) তাদের পন্যের দাম ও খুব দ্রুত উঠা নামা করে। বিশেষ করে তাদের সেই বাজারের মূল নিয়নন্ত্রা হলো প্রথম বিশ্বে ধনী দেশ গুলো।
“ ৭০ এর মাঝা মঝি সময়ে, ১ পাউন্ড চিনির মূল্য মাত্র ৬৪ সেন্ট থেকে ৬ সেন্টে নেমে আসে তা ১৮ মাস পর্যন্ত চলতে থাকে। তাঞ্জানিয়ার পঞ্চ বার্ষিক পরিকল্পনায় বিশ্ব বাজারের জন্য সিসালের মূল্য নির্ধারন করা হয়েছিলো ৯০ পা; কিন্তু এর পরই তার দর পতন হয়ে নেমে আসে মাত্র ৬০পাউন্ডে। পঞ্চাশের দশকে ও কোকোর মূল্য ১০০০ ডলার থেকে নেমে ৪০০ ডলারে চলে আসে। পরে আবার তা ১০০০ ডলারে উঠে যায়। আবার তা নেমে আসে ৬০০ ডলারে। ১৯৭৪ সালে জাম্বিয়ায় তামার দাম ছিলো এপ্রিলে ৩,০৩৪ ডলার পরে তা নেমে আসে ১,২৯০ ডলারে”। (১৬)
উন্নয়ন শীল দেশ সমূহে অর্থকরী ফসল উৎপাদনের নামে তাদের ঐতিহ্যবাহী অর্থনীতিকে ধ্বংস করে ফেলে এবং তাদেরকে অন্যের উপর নির্ভর্শীল করে তুলে। প্রথম বিশ্বের ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। ১৯৬০ সালে, ২৫ টন রাবারের বিনিময়ে শ্রীলংকার পেত হত ৬ টি ট্রাকের কিন্তু ১৯৭০ সালে তারা কেবল মাত্র পায় ২ টি ট্রাক। একেই ভাবে কলার দাম ১৯৫০ সালের তুলনায় ১৯৭০ সালে ৩০% কমে যায়। (১৭) তেরিযা বলেন এই প্রক্রিয়া এখনও থামে নাই । তা এখন ও অভ্যাহত আছে। ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৯০ সালে তথাকথিত মুক্ত বাজার ব্যবস্থা হাইতির কৃষি বিভাগকে বিনাশ করে দিয়েছে। ১৯৮৬ সালে হাইতি তাদের খাবারের জন্য মাত্র ৭,০০০টন চাল আমদানি করেছিলো। কিন্তু আমেরিকা তাদের ১৯৮৫ সালের কৃষিতে ভর্তুকী বিলের আওতায় চাল উৎপাদন করে সস্তায় চাল উৎপাদন করে
বাজার চয়লাব করে দেয়। ফলে হাইতির কৃষিকগন বাজারে নিজেদের পন্যের দাম ঠিক রাখতে না পারে কৃষিকাজে অনিচ্ছুক হয়ে পড়ে। ফলে ১৯৯৬ সালে হাইতি ১৯৬,০০০ টন খাদ্য আমদানী করতে বাধ্য হয়। যার বাজার মূল্য ১০০ মিলিয়ন ডলার। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই হাইতির চাল উৎপাদনের হার কমে যায়। হাতির মানুষ বিদেশের উপর খাদ্যের জন্য নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। অন্য দিকে খাদ্যের দাম ও বাড়তে থাকে । হাইতির মানুষ বিশেষ করে নগরের দরিদ্র মানুষ চরম বিপাকে পড়ে যায়। (১৮) এই ভাবে উন্নয়নশীল দেশ সমূহ একটি দুষ্ট চক্রে জড়িয়ে যায়। তাঁরা অর্থ করী ফসল উৎপাদনে অতিরিক্ত মনোযোগ দিয়ে বসে। উৎপাদন ও বাড়িয়ে দেয় কিন্তু তাদের পন্যের দাম কমে যায় । ফলে তা তাদের জন্য মরন ফাঁদ হয়ে উঠে। সেই পরিস্থিতিতে ঠিকে থাকের জন্য অধিক হারে ঋন করতে থাকে। (১৯) প্রথম বিশ্ব হয় ধনী আর তৃতীয় বিশ্ব হয় ঋনী। দারিদ্রতা ও পরনির্ভরতা তাদের নিত্য সঙ্গী হয়ে উঠে।
সাহায্য ও বিনিয়োগের নামে প্রহেলিকা
সাম্রাজ্যবাদী দেশ সমূহ উন্নয়নশীলদেশ সমূহের উপর তাদের বাজার উন্মূক্ত করনের জন্য চাপ প্রয়োগ করে থাকে। সাম্রাজ্যবাদিরা সেই সুযোগে স্থানীয় বাজারকে পন্যের প্লাবনে ভাসিয়ে দেয় এবং সেই সকল দেশের স্থানীয় উৎপাদনের সর্বনাশ করে ফেলে। সাম্রাজ্যবাদী দেশ গুলো তখন একক বাজার কায়েমের সুযোগ তৈরী করে ফেলে। হাইতার প্রথম বিশ্ববাদি ও সাম্রাজ্যবাদিদের দাবীর অসারতা প্রমান করেন যে তাঁরা দরিদ্র দেশে বিনিয়োগ করে সেখান কার জন্য কল্যান করে থাকেন। হাইতার মন্তব্য করেন যে, তৃতীয় বিশ্বে প্রথম বিশ্বের বিনিয়োগ হলো আসলে সেখানকার সম্পদ লুণ্ঠনের পথ উন্মূক্ত করা । গ্যান্ডার ফ্রাঙ্ক সেই প্রক্রিয়ার বর্ননা করেন এই ভাবেঃ
“ বৃটিশরা ভারতীয় সম্পদ লুন্ঠনের জন্য দুইটি খাল কেটে ছিল এর একটি হলো রেলপথ আর অন্যটি ছিলো ঋন দান করা। রেল সড়কের মাধ্যমে কেবল সেখানকার অর্থনীতিকে বস্তুগত ভাবে পরিবর্তন করা নয় বরং তাদের উৎপাদিত পন্য সর্বত্র বিক্রি করার ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলো। সেই কাজ ভারতের মাটিতে করতে বাঁধা দেবার মত শক্তি বা সামর্থ তখন ভারতীয়দের ছিলো না । ‘ভারতী ঋনের’ নামে উপনিবেশিক শক্তি জনগণের উপর নানা ভাবে সূদের হার নির্ধারন করে দিত। তাদের আসল মতলব ছিলো জনগণের আয়ের উদ্বৃত্ব অংশটি নিজেরদের পকেটে ভরা”। (২০)
বিদেশী বিনিয়োগ সত্যিকার অর্থে স্থানীয় ব্যবসাকে বিনাশ করে দেয়। গ্যান্ডার ফ্রাঙ্ক লিখেছেন,
“ রেলওয়ে নেট ওয়ার্ক এবং বৈদ্যুতিক লাইন, এই গোলো কেবল নেট বা লাইন নয়, ইহা কোন কোন সময় প্রত্যন্ত অঞ্চলের অর্থনীতিকে যুক্ত করে, তা একটি দেশ বা কোন কোন ক্ষেত্রে একাধীক দেশকে ও সংযুক্ত করে দেয়। যার ফলে সম্পদের আদান প্রদানের বাহন হয়ে উঠে। সামগ্রীক ভাবে তা নগরায়নের সাথে একাট্রা হয়ে পড়ে”। (২১)
উন্নয়নশীল দেশ সমূহের সম্পদ ভেতরে প্রবেশের বদলে বেশী মাত্রায় বাহির হয়ে যায়। ফলে উপকৃত হয় সাম্রাজ্যবাদী দেশ সমূহ। হাইতার রিচার্ড জে, ব্রানেট এবং রোনাল্ড ই, মুলার এর কথা এখানে উল্লেখ করেন, তাদের মতে, “ উল্টো কল্যাণ সাধন”, “এটা অস্বাভাবিক হলে ও দরিদ্র দেশ সমূহ হলো সামগ্রীক ভাবে পুঁজি ও সম্পদের অমিয় উৎস। যেখান থেকে বিশ্ব বানিজ্য সংস্থা গুলো দেদারছে মুনাফা অর্জন করে থাকে”। হাইতার আরো বলেন, যে পুঁজি উন্নয়নশীল দেশে “বিনিয়োগ” করা হয়ে থাকে, তা থেকে বিনিয়োগ কারীরা গড়ে ৮০% পর্যন্ত মুনাফা অর্জন করে থাকে। (২২) আসলে সাম্রজ্যবাদিরা বিনিয়োগ ও সাহায্যের নামে তৃতীয় বিশ্বের মানুষের সাথে প্রহেলিকাই করে থাকে”।
আরো একটি বিষয় লক্ষ্যনীয় যে, তৃতীয় বিশ্ব সাহায্য দেবার সময় নানা প্রকার শর্ত আরোপ করে থাকে সাম্রাজ্যবাদী চক্র। তাঁরা সেখানে “মুক্ত বাজার” ও সংস্কারের নামে ঋন দেবার আগে বহু শর্ত আরোপ করে থাকে। এদের মধ্যে আই এম এফ অন্যতম। এছাড়া এরই মধ্যে সাম্রাজ্যবাদিরা তৃতীয় বিশ্ব থেকে “কম দামে পন্য” আমদানী করার জন্য ব্যবস্থা করে রেখেছে। প্রায়স অ্যামেরিকার ট্রেড ইউনিয়ন সমূহ নিজেদের জন্য চাদা আদায়ে “ মার্কিন ক্রয়” নামে অর্থ উপার্জন করে থাকে। হাইতার বলেন, সাহায্য ও সহযোগীতার নামে উন্নয়নশীল দেশ সমূহকে সাম্রাজ্যবাদ প্রভাবিত করে থাকে। তিনি লিখেছেন, বিগত শতকে সাহায্যের এক তৃতীয়াংশই ছিলো ঋন হিসাবে। যা অনেক মুনাফা ও সূদ সহ ফেরত এসেছে প্রথম বিশ্বে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্বের পর থেকে সাহায্য নামক বিষয়টি সর্বত্র এক বিশেষ ভূমিকা পালন করে এসেছে। সাহায্যের ক্ষেত্রে মুৎসুদ্দি ও সাম্রাজ্যবাদী উভয়েরই স্বার্থ জড়িত। সহায়তা হলো বানিজ্য সংস্থা গুলোর জন্য ঘুষ প্রদানের মত। সহায়তাকে সাম্রাজ্যবাদী চক্র তৃতীয় বিশ্বকে তাদের আয়ত্বে রাখার কৌশল হিসাবে ব্যবহার করে থাকে। প্রেসিডেন্ট জন এফ. কেনেডি ১৯৬১ সালে বলেছিলেন, “ আমাদের দেয়া আন্তর্জাতিক সাহায্য হলো একটি চমৎকার হাতিয়ার যা দ্বারা আমরা অন্যান্য দেশ সমূহকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত করতে পারব, যদি কোন দেশ সমাজতন্ত্রের দিকে ঝুঁকে পড়ে তবে তাকে আমরা সাহায্য দিয়ে ফিরিয়ে আনব”। ১৯৬৮ সালে নিক্সন বলেছিলেন, “ অ্যামেরিকার সাহায্য অন্য জাতির জন্য নয় তা মূলত আমাদের নিজেদের স্বার্থেই তা আমরা ব্যবহার করে থাকি”। মুলত সাহায্য সাম্রাজ্যবাদের প্রভাবকেই অধিকতর শক্তিশালী করে থাকে। এটা একটি ক্ষুধার্থ জাতির সামনে একটি মূলা ঝুলানোর মত অবস্থা। হাইতার উদাহরন হিসাবে বলেন কেমন করে আমেরিকা একটি বামপন্থী বাংলাদেশী মুজিব সরকারকে খাদ্য দেবার কথা বলে পরে প্রতারনা করে তা ভিন্ন ভাবে সংকটের সৃষ্টি করে তাদের সর্বনাশ করে ফেলে। খাদ্যের জাহাজ মাঝ পথে আটকে দিয়ে আমেরিকে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি করে। সেই দুর্ভিক্ষে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে প্রায় ২৭,০০০ এবং এর পর ১০০০০০ মানুষ মানব সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে মারা গিয়েছিলো”। হাইতার নিশ্চিত ভাবে বলেন, “ আমেরিকা খাদ্য নিয়ে সর্বদাই রাজনীতি করেছে”। বাংলাদেশের মানুষ খুব ভালো করেই জানে আমেরিকা তাদের সাথে খাদ্য নিয়ে খেলাই না খেলেছে। খাদ্য দেয়ার কথা বলে, তা পাটাতে উদ্দ্বশ্য মূলক ভাবে দেরী করে, এবং তা ফিরিয়ে নেয়। আমেরিকা তখন ও বাংলাদেশকে চাপ দিচ্ছিলো কলখারখানা ব্যাক্তি মালিকানায় ছেড়ে দেবার জন্য। কিউবার সাথে সম্পর্কে না জড়ানোর জন্য। কিন্তু বঙ্গ বন্দ্বুর সরকার সেদিন অ্যামেরিকার কথা শুনেনি। তাই হয়ত সি আই এর সহায়তায় শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করেছিলো, অ্যামেরিকার উদ্দেশ্য ছিলো তাদের কোন একজন বন্দুকে বংলাদেশের ক্ষমতায় বসানো। (২৩)
সাম্রাজ্যবাদিরা ও তাদের সহযোগী মুৎসুদ্দিরা সাহায্য দেবার ক্ষেত্রে নিজেদেরকে মানবতাবাদি বা দেশ প্রমিকের আদর্শের আবরনে ঢেকে দেয়। মার্কিনীরা প্রায়স বলে বেড়ায় তাঁরা নাকি দুনিয়ার সব চেয়ে বেশী দানশীল। তাঁরা প্রশ্ন করে তৃতীয় বিশ্বের মানুষ কেন তাদেরকে ঘৃনা করে? কেন তাদেরকে মেরে ফেলতে চায়? আর মার্কিনীদের দালাল চক্র বলে বেড়ায় তাঁরা হলো অ্যামেরিকার সহযোগী। তাঁরা চাইলেই নাকি “অ্যামেরিকার মত জীবন যাপন করতে পারেন”। তাঁরা নাকি অ্যামেরিকার মত উন্নয়ন ঘটাতে পারবেন। মুৎসুদ্দিরা বিপ্লবীদেরকে ঘৃনা করেন, তাদেরকে বলে বিপ্লবীরা দেশ দ্রোহী ইত্যাদি। এঁরা উদাহরন হিসাবে রেললাইন ও পাওয়ার লাইনের প্রশংসা করে। এঁরা প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের লালন করে। শ্রেনী সংগ্রামের প্রবল বিরুধীতা করে। প্রথম বিশ্বের প্রশংসা করে থাকে। তাঁরা উদাহরন হিসাবে চীনের উৎপাদন শক্তি তত্বের ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পুনঃ মূল্যায়নের প্রশংসা করে। তেরিজা হাইতার তার লিখনিতে প্রথম বিশ্ববাদের সাহায্য ও সহযোগীতার প্রহেলিকার ও মিথ্যা আশ্বাসের ও তাদের ভন্ডামীর চিত্র তুলে ধরেছেন।
শ্রমিক ও মূল্যের সঞ্চালন
কার্ল মার্ক্সের কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো অনুসারে প্রচলিত উন্নয়ন ব্যবস্থা উন্নয়নশীলতাকে বাধাগ্রস্থ করে দেয়। প্রথম বিশ্ব তৃতীয় বিশ্বের শ্রমিকদেরকে অবদমিত করে রাখার চেষ্টা করে। এছাড়া ও প্রথম বিশ্বের শ্রমিকেরা যে সকল সুযোগ সুবিধা পায় যেমন শিশুর লেখা পড়া, চিকিৎসা ভাতা, উচ্চ বেতন ভাতা গৃহায়ন সুবিধা ইত্যাদি তা কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের শ্রমিকেরা পায় না । এটা চলে এসেছে সূদির্ঘ কাল থেকে। বহু জাতিক কোম্পানী সমূহ তাদের উৎপাদিত পন্য উৎপাদনের জন্য নানা প্রকার আইনের আওতায় প্রথম বিশ্বের শ্রমিকদেরকে বেশী সুবিধা দেয় কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের কর্মজীবী মানুষ তা পায় না । সেখানে কর্মে নিয়গের ক্ষেত্রে ও বৈষম্য দেখা যায় । অপর দিকে দেখা যায় যে তৃতীয় বিশ্ব যে সকল উন্নত কর্ম জীবী তৈরী করে যেমন ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি তাদেরকে প্রথম বিশ্ব ব্রেইন ড্রেনের মাধ্যমে টেনে নিয়ে আসে। যারা তৃতীয় বিশ্বে খরচে তৈরী হলো তাঁরা কাজ করলেন প্রথম বিশ্বের জন্য । উপকৃত হলো
প্রথম বিশ্ব কিন্তু বঞ্চিত হলো তৃতীয় বিশ্বের মানুষ। প্রথম বিশ্ব এমন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করে রাখে যে, তাঁরা যেন খুব অল্প টাকায় শ্রমিক তৃতীয় বিশ্ব থেকে আমদানী করতে পারে। সাম্রাজ্যবাদ তৃতীয় বিশ্বের দেশ সমূহে নানা ভাবে রাজনৈতিক ও সামাজিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে যেন মানুষ দেশ ছাড়তে, পলায়ন করতে বা বেকারত্বের অভিষাপ নিয়ে তাদের দেশে গিয়ে বহুজাতিক কোম্পানী ও অন্যান্য কল কারখানায় কাজ করতে বাধ্য হয়। অধিকন্তু এঁরা তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে নানা প্রকারের বিদ্রোহে ইন্দন দেয়, আবার সরকারকে দিয়ে নির্ম নিপিড়ন চালায়, আত্মঘাতি হামলাকারী সৃজন করে অত্যন্ত পরিকল্পিত ভাবে। এদের উদ্দেশ্য হলো স্বল্প খরচে শ্রমিক প্রাপ্তি ও শ্রম শোষণ করা । এটা ও অতীতের উপনিবেশবাদের মানসিকতা থেকে সৃজিত এক ধরনের প্রকল্প। (২৪)
আলকিত সাম্যবাদিগন প্রায়স বলছেন যে, কার্ল মার্ক্স যে প্রলেতারিয়েত শ্রেনীর কথা বলেছিলেন তা এখন কেবল তৃতীয় বিশ্বেই বিদ্যমান আছেন। তৃতীয় বিশ্বের শ্রমিকদের সত্যিকার অর্থেই শৃংখল ছাড়া হারাব আর কিছু নেই। তাঁরা সমাজের অন্যান্য অংশ থেকে ইতি মধ্যে আলাদা হয়ে গেছেন তাদের এখন বেঁচে থাকতে হলে শ্রম বিক্রির আর কোন বিকল্প নেই। শ্রম বিক্রি করেই তাদেরকে দিনাতিপাত করতে হবে। তাঁরা সকাল সন্দ্ব্যা শ্রম বিক্রি করেন প্রতিদিন ১০-১৪ ঘন্টা এবং সপ্তাহে ৬- ৭ দিন কয়াজ করছেন। পক্ষান্তরে, প্রথম বিশ্বের শ্রমিকেরা বিলাশ বহুল জীবন যাপন করেন। তাদের নিজস্ব গৃহ, গাড়ী, কম্পিউটার, টেলিভিশন, রেডিও, ওভেন, উন্নত পানির ফিল্টার ইত্যাদি ব্যবহারের সকল দ্রব্যাদি তাদের আছে। এমন কি তাদের অনেকেরই বড় বড় বিনিয়োগ পর্যন্ত আছে। তাদের কাজ কর্ম আনন্দময় পরিবেশে অবস্থিত। সপ্তাহের ছুটির দিনে তাঁরা নানা স্থানে ভ্রমনের ও সুযোগ পেয়ে থাকেন। তাদের অনেকে এখন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে নিজেদেরকে বুর্জোয়া হিসাবে বিবেচনা করে থাকেন, তা হলে তাঁরা তৃতীয় বিশ্বের শ্রমিকের সাথে কি ভাবে ঐক্যবব্দ হবেন। এটা স্পষ্ট যে এখন প্রথম বিশ্বের একজন শ্রমিক যা পায় তা অন্যদেরকে শোষণ করার স্তর থেকে পেয়ে থাকে; তাঁরা বিশ্ব উৎপাদনের অংশ হিসাবে যা পায় বা পাওয়ার কথা তাঁরা এর চেয়ে অনেক বেশী পেয়ে থাকে। প্রথম বিশ্বের শ্রমিকেরা শিকল নয় অনেক কিছু হারাতে হবে। তাঁরা এখন শাসক শ্রেনীর সাথে এক যোগে তৃতীয় বিশ্বের বিরুদ্বে কাজ করছে। এঁরা এখন সম্পত্তিবান শ্রেনীর বন্দ্বু। হাইতার নিজে ও প্রথ বিশ্বের আয় ও তৃতীয় বিশ্বের আয়ের পার্থক্য নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন প্রথম বিশ্বের সামাজিক শান্তি ও স্থিতি নির্ভর করে তৃতীয় বিশ্বের দেশ সমূহকে উন্নয়নশীল রাখার উপর। সাম্রাজ্যবাদ সম্প্ররকে সিল রুড লিখেছেন,
“ আমি এখন পৃথিবীর পূর্ব প্রান্তে… কতিপয় বেকার মানুষের সভায় হাজির ছিলাম। আমি তাদের কিছু কষ্টের কথা লিখে রেখেছি, সেই কথা গুলো হলো “রুটি” “রুটি” আর “রুটি”, আমি আমার বাড়ীর পথে হাটতে হাটতে ভাব ছিলাম সেই কষ্টের কথা গুলো তখনই আমি বুঝতে পারছিলাম সাম্রাজ্যবাদ কথাটি কত গুরুত্বপূর্ন…আমার চমৎকার ভাবনা হলো সামাজিক সমস্যার সমাধান করা। অর্থাৎ যুক্ত্রাজ্যের ৪০,০০০,০০০ অধিবাসীকে গৃহ যুদ্ব থেকে নিরাপদ রাখা। আমার ভাবনা ছিলো আরো নতুন ভূমি আবিস্কার করা আর সেখানে অতিরিক্ত মানুষকে পাঠিয়ে দেয়া। তাদের জন্য নতুন বাজার, নতুন উৎপাদনের ব্যবস্থা করে দেয়া… একজন রাজা হিসাবে আমি সর্বদাই ভাত কাপড়ের কথা ভাবি”। (২৫)
সাম্যবাদি মিঃ দত্ত ১৯৫০ সালে লিখেছিলেনঃ
“ সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ অর্থনীতি মানেই পরগাছা অর্থনীতি। ইহা নিজের অস্থিত্ব রক্ষার জন্য বিশ্ব ব্যবস্থার উপর নির্ভর করে থাকে। প্রথম বিশ্ব যুদ্বের প্রারম্ভে বিশ্বের রপ্তানির পাঁচ ভাগের দুই ভাগ একাই রপ্তানি করত; এই রপ্তানির মাত্রা দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ব পর্যন্ত বাড়তে থাকে… ১৯৫১ সালে [গুরুত্বপূর্ন উদ্বৃত্ব] সেই হিসাবে দাঁড়ায় ৭৭৯ মিলিয়ন পাউন্ডে”।(২৬)
তৃতীয় বিশ্বের অর্থ সম্পদ প্রথম বিশ্বের মানুষের আয়েশী জীবন যাপনের জন্য তাদের সূখ ও সস্থির জন্য পাচার হয়ে যায়। তাঁরা এমন এক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে যাতে সহজেই তৃতীয় বিশ্বের সম্পদ লুন্ঠন করা যায়। হাইতার সামির আমিন সহ অন্যান্য লিখকের বক্তব্য উল্লেখ করে অসম বিনিময়ের চিত্র তুলে
ধরেছেন।
“ উন্নয়নশীল দেশ সমূহ যা উৎপাদন করেন তা খুবই কম মূল্য পায়। পক্ষান্তরে, প্রথম বিশ্ব বা উত্তর আমেরিকা ও ইউরূপ যা উৎপাদন করে তা অধিক মূল্য ধারন করে ফলে পারস্পরিক বিনিয়ম কালে পার্থক্যটা দাড়ায় ব্যাপক হারে। সামির আমিন বিশ্ব ব্যাপী একটি জরিপের মাধ্যমে এর পরিসংখ্যান তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, ১৯৬৬ সালের হিসাব মতে উন্নয়নশীল দেশ সমূহ ৩৫,০০০ মিলিয়ন ডলার তাদের রপ্তানী বানিজ্য থেকে আয় করে । এ ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্র থেকে পায় মাত্র ২২,০০০ ডলার যেমন কর্মীদের বেতন ইত্যাদি। এই গুলো উন্নয়নশীল দেশ সমূহের সর্বমোট বিনিয়োগের সমান”।(২৭)
তেরিযা হাইতার আরো একটি গুরুত্বপূর্ন দিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষন করেছেন, তা হলো উচ্চতর প্রযুক্তির কারনে উন্নত পন্য উৎপাদনের বিষয়ে। যাদের উন্নত প্রযুক্তি থাকে তাঁরা উন্নত পন্য উৎপাদন করে বাজারে বিশেষ সুবিধা নিয়ে থাকে। উন্নত দক্ষতা সম্পন্ন শ্রমিক থাকলে ও তা কাজে লাগে। উন্নত প্রযুক্তি ও দক্ষ শ্রমিকের উৎপাদিত পন্যের বাজারে বেশী দাম পাওয়া যায় । এই কথা গুলো প্রথম বিশ্বের লোকেরা বলেই তৃতীয় বিশ্বের মানুষের চেয়ে বেশী সুবিধা নিয়ে থাকেন। তাঁরা বলেন প্রথম বিশ্বের শ্রমিকেরা বেশী দক্ষ বলেই বেশী পাওয়ার অধিকারী। কার্ল মার্ক্স প্রথম বিশ্ববাদিদের এই যুক্তির বিরুদ্বে কথা বলেছেন, ( প্রথম বিশ্বের লোকেরা খুব কমই উৎপাদন করেন) উৎপাদন কারীদেরকে তাদের উৎপাদনের ক্ষমতা অবারিত করে দিন আর দেখান ফলাফল কি দাঁড়ায়। পুঁজিবাদীদের ন্যায় প্রথম বিশ্ববাদিরা কথা বলেন না, তাঁরা বলেন প্রথম বিশ্বের লোকেরা বুদ্বির দিক থেকে অনেক অগ্রসর, তাঁরা কি মানসিক ভাবে বেশী শ্রম দিচ্ছেন না ? অনেক সুপার স্টার নির্বাহী কর্মকর্তা আছেন যারা বলেন, তাদের নিকট সৃজনশীল ও চমৎকার পরিকল্পনা আছে ,তা অনুযায়ী কাজ না করলে কোম্পানী ব্যার্থ হয়ে যাবে । এই সকল ক্ষেত্রে অনেক রকমের মিথ বা কল্পকাহীনি চালু আছে। তাঁরা প্রচার করেন তৃতীয় বিশ্বের চেয়ে প্রথম বিশ্বের শ্রমিকেরা বেশী উৎপাদন করেন। অ্যামেরিকার ১৯৭৩ সালের সুল্ক কমিশনের প্রতিবেদন অনুসারে জানা যায় যে, একেই রকমের কারখানায় উৎপাদনে তেমন কোন পার্থক্যই দেখা যায়নি। (২৮) তেরিজা ও তার গবেষণায় রমান করেছেন, একটি উন্নয়নশীল দেশের উৎপাদন ও উন্নয়ন শীল দেশের উৎপাদনের হারের মধ্যে কোন তারতম্য নাই। যদি ও উন্নয়নশীল দেশের যন্ত্রপাতি পুরাতন, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করে, বেশী সময় নিয়ে কাজ করে, বেতন কম পায় কিন্তু এর পর ও তৃতীয় বিশ্বের শ্রমিকেরা উৎপাদনে পিছিয়ে নেই। (২৯)
তেরিযা, অর্গারী ইমানূয়েল ও চার্লস বেথেলহেইম একমত হয়ে বলেছেন যে, প্রচলিত পুঁজিবাদী ব্যবস্থার আওতায় প্রথম বিশ্বেও শ্রমিকদের যে বেতন কমানো হচ্ছে তা কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের শ্রমিকদের বেতন বৃদ্বির জন্য নয়, তা করা হচ্ছে পুঁজিপতিদের মুনাফা আরো বাড়ানোর জন্য। কেহ মানুন আর না ই মানুন প্রথম বিশ্বের সামাজিক ব্যবস্থার উপাদান গুলো উন্নয়ন হবার কারনে সেখানকার শ্রমিকরা ও উপকৃত হচ্ছে, তারা তাদের সহযোগী শোষকদের দ্বারা সুবিধা নিচ্ছে, কিন্তু এর ফলে তৃতীয় বিশ্বের মানুষ এক বিরুপ পরিস্থিতির মুখোমুখী হচ্ছে। যদি ও প্রথম বিশ্বে শোষক শ্রেনীর ভেতরেই দ্বন্দ্ব চলছে, যেমন- প্রথম বিশ্বের পুঁজিপতি বনাম প্রথম বিশ্বের শ্রমিক শ্রেনীর মাঝে চলমান দ্বন্দ্ব। কিন্তু এই দ্বন্দ্বকে কোন ভাবেই বৈরী দ্বন্দ্ব বলা যায় না । তা আসলে একটি অবৈরী দ্বন্দ্ব। এদের উভয়ই উভয়ের সহযোগী। এরা সামাজিক উৎপাদনে নিজেদের অংশ বৃদ্বির জন্যই কাজ করে। এরা পুঁজিবাদ – সাম্রাজ্যবাদকে তৃতীয় বিশ্বের বিরুদ্বেই ব্যবহার করতে চায়। আর সেই জন্যই লিডিং লাইট সাম্যবাদিরা প্রথম বিশ্বের তথাকথিত মজুরী বৃদ্বির আন্দোলনে সরিক হতে চায় না । সেই মজুরী বাড়ানোর সংগ্রাম বা আন্দোলন আসলে দুইটি শোষক চক্রের মধ্যকার সংগ্রাম। কে জিতল বা হারলো তাতে কিছুই যায় আসে না। সত্যিকার অর্থে তৃতীয় বিশ্বই হেরে যাবে বা আরো ক্ষতি গ্রস্থ হবে। তবে লক্ষ্যনীয় যে, হাইতার একটি বিষয়ে বুঝে পারেননি তা হলো, সমাজতন্ত্রের আওতায়, প্রথম বিশ্বের সম্পদ দুনিয়ার বেশীর ভাগ মানুষ যেখানে বসবাস করেন অর্থাৎ তৃতীয় বিশ্বের মানুষের মাঝে পুনঃ বন্ঠন করা হবে। এতে প্রথম বিশ্বের শোষক শ্রেনীর ক্ষতি হবে। এরা হলো প্রথম বিশ্বের পুঁজিপতি শ্রেনী ও প্রথম বিশ্বের শ্রমিক শ্রেনী
উভয়কেই নিজেদের অংশের ভাগ দিতে হবে। সত্যিকার ভাবে, বিশ্ব সম্পদ পুনঃ বন্ঠনের প্রশ্নে প্রথম বিশ্বের জনগণ সাম্রাজ্যবাদকেই সমর্থন দিয়ে থাকে। আর সেই কারনেই অনেক সংশোধনবাদী চক্র সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের বাহক হয়ে উঠেন কিন্তু আন্তর্জাতিকতাবাদে আস্থা রাখেন না । অধিকন্ত, সমাজতন্ত্র প্রথম বিশ্বের চলমান ভোগের মাত্রা কমিয়ে দিবে। এটা পরিবেশ প্রতিবেশের জন্য যেমন দরকার আবার সীমাহীন ভোগের কারনে তাঁরা মারাত্মক ভাবে তৃতীয় বিশ্বের শ্রমিকদেরকে ক্ষতিগ্রস্থতা থেকে ও রেহাই দিবে। সামগ্রীক ভাবে মানবতাকে নিরাপদ করতে সহায়ক হবে।
আজকের দুনিয়া
তেরিজা হাইতার যে অবস্থার বর্ননা দিয়ে বইটি প্রকাশ করেছিলেন এর পর বিগত তিন দশক পার হয়ে গেলেও পরিস্থিতির তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি। তবে, বিগত দশক সমূহে, উন্নয়নশীল দেশ সমূহ একটি নতুন অবস্থার দিকে মোড় নিয়েছে। যদি ও হাইতার ক্রিয়েশন অব পবার্টি নামক বইটি প্রকশ করে একটি গুরুত্ব পূর্ণ কাজ করেছেন কিন্তু এর পর ও কিছু বিষয়ে শূন্যতা রয়েই গেছেঃ তিনি কেবল একটি দিকের প্রতি সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন কিভেবে তৃতীয় বিশ্বের সম্পদ লুন্ঠন করা হচ্ছে। আর কিভাবে প্রথম বিশ্বে সম্পদ পুঞ্জিভূত করা হয়েছে। তিনি এড়িয়ে গেছেন কিভেবে প্রথম বিশ্ব তৃতীয় বিশ্বের সমাজের ঊপর কর্তৃত্ব প্রতিস্টা করেছে। নিজেদের অর্থনীতিকে কিভাবে ব্যবহার করে বিগত কয়েক দশকে তৃতীয় বিশ্বের উপর খবরদারী কায়েম করেছে। লিডিং লাইট সেই পরিস্থতির কিছু চিত্র তুলে ধরছেঃ
“ কার্ল মার্ক্স যে ভাবে বিশ্ব সমাজকে দেখেছিলেন আজকের সমাজ কিন্তু ঠিক সেই ভাবে বিভক্ত নয়। বরং বিভিন্ন দেশে নানা ভাবে সামাজিক বিভাজন বিরাজ করছে। কিছু দেশ আছে যারা তেমন কিছুই এখন আর উৎপাদন করেন । আর এর বড় উদাহরন হলো প্রথম বিশ্বের সপিংমল অর্থনীতি। প্রথম বিশ্বের মানুষের জীবনে এখন আর কারখানা কেন্দ্রিক অর্থনীতি তেমন প্রভাব বিস্তার করে না। খুবই অল্প একটি অংশের মানুষ এখন প্রথম বিশ্বে সরাসরি উতপাদনে যুক্ত আছেন। সেই তুলনায় এখন সেখানে বিশাল জনশক্তির প্রায় সকলেই সেবা বা ব্যবস্থাপনার কাজে জড়িত আছেন। মার্ক্সের বর্ননা মতে, বিপুল সংখ্যার শ্রমিক উৎপাদন শীল কাজে জড়িত হবেন, যারা সামাজিক উৎপাদনকে বৃদ্বি করবেন। প্রথম বিশ্বের প্রায় দেশেই এখন সপিংমল অর্থনীতি প্রভাব বিস্তার করে আছে। সপিং মলে কিছুই উৎপাদন হয় না। সেই ক্ষেত্রে মানুষ ব্যবস্থাপনায়, পরিবহনে, নিরাপত্তায় নিয়োজিত হয়েছে। পন্য দ্রব্য উৎপাদন হয় ভিন্ন এক জায়গায় আর সেই পন্য বিক্রি হয় সপিং মলে। মালামাল এসে জমা হয় অন্য কোন দেশ থেকে আর তা সপিংমল জমাকরে আর ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে বিক্রি করে । সেই উৎপাদনকারী দেশ সমূহই হলো তৃতীয় বিশ্বের দেশ। সরাসরি উৎপাদনে কেবল তৃতীয় বিশ্বের মানুষই জড়িত। বিপ্লবী চেতনা কেবল তাদের মাঝে থাকা সম্ভব। সেই বিষয়েই ফ্রেডারিক এঙ্গেলস ইংলিশ শ্রমিকদের ব্যাপারে বলেছিলেন, ইংলিশ শ্রমিক রা সারা বিশ্ব তথা ভারতীয়দের তুলনায় বুর্জোয়াকরন হয়ে গেছে”। (৩০)
অর্থাৎ ওদের মাঝে বিপ্লবী চেতনা নেই।
যদিও তেরিজা পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে “সমাজতন্ত্র” সম্পর্কে ভাসাভাসা কথা বলেছেন কিন্তু তিনি স্পস্ট করতে পারেননি উন্নয়নশীল তৃতীয় বিশ্বের দেশজ অর্থণিতি কিভেবে প্রথম বিশ্বের অর্থনীটিকে প্রভাবিত করছে। হাইতার ব্যাখ্যা করতে পারেননি, সমাজতন্ত্র হলো সমাজের একটি অমূল পরিবর্তনকারী আদর্শ। বর্তমানে প্রথম বিশ্বের জীবন যাত্রা পরিবেশগত, বস্তুগত বা আদর্শগত ভাবে একেবারেই ঠেকসই নয়। সমাজতান্ত্রিক পুনঃ বন্ঠন ব্যবস্থা প্রচলিত বিশ্বের বিশেষ করে প্রথম বিশ্বের মানুষের আয় ও জীবন যাত্রার মানকে নিচে নামিয়ে আনবে। প্রথম বিশ্বের শ্রমিক ও অন্যান্য জনগণ তৃতীয় বিশ্বের মানুষের উৎপাদন করা উদ্বৃত্ত অর্থ দিয়ে বিলাশ বহুল জীবন যাপন করবেন তা কোন ভাবেই অনুমোদন যোগ্য হবে না । সমাজতন্ত্রের আওতায়, প্রথম বিশ্বে প্রচলিত ভোগবাদি সংস্কৃতি ও বিপুল পরিমান এনার্জির ব্যবহার নিয়ন্ত্রন করা হবে, কেননা তা এক দিকে যেমন অন্যায় অন্য দিকে তা পরিবেশ বান্দ্বব ও নয়। তেরিজা বুঝেতেই পারেন নাই, শোষিত দেশ সমূহের সর্বহারা শ্রেনীর একনায়কত্ব নতুন শক্তি হিসাবে কিভাবে শোষক শ্রেনীর উপর প্রধান্য বিস্তার করতে পারে। আজকে যদি
তেরিজা হাইতার এই পুস্তকটি লিখতেন তা হলে হতি তিনি অনেকের কাছেই বিরাগভাজন হতেন। সেই বিরাগভাজন মানুষেরাই সাধারণত বুদ্বি বৃত্তিক স্তরে আলোকিত সাম্যবাদের সমর্থক হয়ে থাকেন। তবে রাজনৈতিক ভাবে সাহসিকতার সাথে এটাকে নিয়ে এগিয়ে যেতে পারে না। আলোকিত সাম্যবাদের কথা গুলো সর্বত্র তুলেও ধরতে পারেন না। জেকবিনের মহান সাংস্কৃতিক বিপ্লব সম্পর্কে তার শিক্ষাকে আমরা মেনে চলতে পারি। সাম্যবাদিদের উচিৎ সামগ্রীকভাবে সাম্যবাদকে সকল কিছুর উর্ধে তুলে ধরা। জয় হোক মেহেনতি জনতার !!
Notes.
1. Marx, Karl. The Manifesto of the Communist Party. http://www.marxists.org/archive/marx/works/1848/communist-manifesto/ch01.htm#007 * It is interesting how often First Worldists invoke Marx’s more popular works, his oversimplifications, against Leading Light Communism. Yet, when confronted by Marx’s more advanced, scientific works, like Capital, with its Third Worldist implications, First Worldists have no response. See: Prairie Fire’s “Revisiting Value and Exploitation.”
2. Hayter, Teresa. The Creation of World Poverty. Third World First. Great Britain: 1990. . pp. 37-39
3. Hayter, p. 38
4. Hayter, p. 38
5. Hayter, p. 48
6. Hayter, p. 20
7. Hayter, p. 52
8. Hayter, p. 54
9. Hayter, p. 69
10. Hayter, pp. 59-63
11. Hayter, p. 53
12. Hayter, p. 57
13. Hayter, p. 57
14. Hayter, p. 67
15. Hayter, p. 67
16. Hayter, p. 68
17. Hayter, p. 67
18. Review of Jean-Bertrand Aristide’s Eyes of the Heart. Monkey Smashes Heaven. June, 10 1910. http://monkeysmashesheaven.wordpress.com/2010/06/10/review-of-jean-bertrand-aristide%E2%80%99s-eyes-of-the-heart/
19. Hayter, p. 67
20. Hayter, pp. 75-76
21. Hayter, pp. 75-76
22. Hayter, p. 77
23. Hayter, pp. 86-87
24. Hayter, pp. 59-63
25. Hayter, p. 71
26. Hayter, pp. 71-72
27. Hayter, p. 64
28. Hayter, p. 97
29. Hayter, p. 107
30. Prairie Fire, Revisiting Value and Exploitation. Monkey Smashes Heaven. June 11, 2010. http://monkeysmashesheaven.wordpress.com/2010/06/11/revisiting-the-value-of-labor-power/