স্বাধীনচেতা নায়ক থিঊ ফ্রেন (ক্লিভ ওয়েন), সাবেক সমাজ বিপ্লবী এখন মদকাসক্ত, তাঁর জীবনের বিশাল অংশই কেটেছে অন্যায়ের বিরুদ্বে লড়াই করে, তিনি তাঁর পুরাতন প্রেমিক জুলিয়ান কর্তৃক অপহরনের আগ পর্যন্ত একটি অফিসে কাজ করতেন। তিনি অভিবাসীদের স্বাধিনতাকামী গেড়িলা নেতার সাথে যুক্ত ছিলেন বলে অভিযুক্ত হন। তিনি কিছু টাকা ও পেতেন কালোবাজারীদের সাথে যুক্ত থাকার কারনে। ক্যা (ক্লায়ার – হোপ আসতি) নিরাপত্তার কারনে ইংল্যান্ডের বাহিরে থাকতেন। তিনি তখন দেখতে পান প্রায় দুই দশক পর রহস্যময় ভাবে ক্যা গর্ভবতী হয়ে পড়েছেন। যখন নতুন ও পুরাতন নেতাদের মাধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিলো, নতুন নেতা লুক সিদ্বান্ত দিয়েছিলো – ক্যা ও তাঁর সন্তান এর বাইরে নয় বরং অভিবাসীদের বিদ্রোহের সময় তাঁরা রাজনীতির প্রতীক হিসাবে ফ্যাসিবাদি রাষ্ট্রের বিরুদ্বে দাঁড়াবে। ফ্যাসিবাদি শক্তি ও স্বাধীনতাকামী গুষ্টির দ্বন্দ্ব যখন চরমে – তখন থিউ এবং ক্যা রাজনৈতিক গোলযোগের কবল থেকে নিজেদেরকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে আসে। তাঁরা মানব প্রকল্প ও শহুরে গোপন বৈজ্ঞানিক দলের সাথে যুক্ত হয়। সেই মানব প্রকল্পটির কাজ হলো মানুষের প্রজনন বিষয়ক সমস্যার সমাধান করা। আর তা তাঁরা করেন তাঁদের নিজস্ব গোপন আস্থানায়। ইহা একটি দ্বীপ সদৃশ্য স্থানে অবস্থিত।
এই চলচ্চিত্রটির চিত্রায়নের একটি উল্লেখ যোগ্য ভালো দিক হলো – ফার্স্ট ওয়ার্ল্ডের রাষ্ট্র সমুহ কত দ্রুত একটি ফ্যাসিবাদি চরিত্র ধারন করে নিরিহ অভিবাসী ও দুর্বল জাতী সমুহের উপর হয়ানার মত আচরন করতে পারে তা দেখিয়েছে। এই সিনেমাতে দেখানো হয়েছে যে, ফ্যাসিবাদি কর্তৃপক্ষ কিভাবে আবু গরীব এবং গুয়ান্তানামো বে ক্যাম্পে অভিবাসী মানুষের উপর নিপীড়ন চালাচ্ছে। এমন কি তাতে দেখানো হয়েছে ইংল্যান্ড ও আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী এজেন্ট হিসাবে কিভাবে বন্দী ও অভিবাসীদের উপর অত্যাচার করছে। ব্রিটিশদেরকে দেখানো হয়েছে তাঁরা তাঁদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিজেদের দেশে সীমাবদ্ব রেখেছে। তবে, এই সিনেমাতে – তাঁদের সাদা জাতিয়তাবাদ, অভিবাসী বিরোধী মনোভাব, এবং পুলিশী রাষ্ট্রের আদলে ফ্যাসিবাদ কায়েমের প্রচেস্টাকে কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে।
এই ছবিটিতে যথার্থভাবেই প্রকৃত বিপ্লবী শক্তিকে চিহ্নিত করেছে । যাদের আবাসস্থল প্রধানত তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলোতে, যারা প্রতিনিয়ত নিপীড়ন আর নির্যাতনের শিকার । এই ছবির পটভুমিকায় নানা শ্রেনীর বিপ্লবী ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মহান ব্যাক্তিত্বের উপস্থিতি দেখা গেছে। থিউর ঘরের দেয়ালে মাওসেতুংগের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পোস্টার দেখানো হয়েছে। গেটু ক্যাম্প থেকে ক্যা ও থিউ পলায়ন করে যে পরিবারের আশ্রয়ে উঠেছিলো -সেই পরিবারের ঘরের দেয়ালে ও লেনিনের ছবি শোভা পাচ্ছিলো। উরা যখন পলায়ন রত তখন তাঁরা দেখতে পায় রাস্তায় একটি সাম্রাজ্যবাদ বিরুধী ইসলামী দল মিছিল করছে। আর এর অদুরেই যুদ্বে শহিদ ফিলিস্তিনিদের জানাজার নামাজ চলছে। পটভূমিতে দেখা গেল এক দল সসস্ত্র ফরাসী সৈনিক তাঁদের জাতীয় পতাকা হাতে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। এই গোলযোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে ও অভিবাসীরা ফ্রান্স থেকে ইংল্যান্ডে পালিয়ে যেতে চাইছে। এই অবস্থায় মার্কিনীরা মেস্কিকানদেরকে যেরূপ বিবেচনা করে, তারা ও সেইরূপ। তাঁরা লুকিয়ে লুকিয়ে এসেছে, ইংল্যান্ডের ভুমিতে প্রবেশের জন্য। ছবির একটি দৃশ্যে দেখানো হয়েছে, কতিপয় গেড়িলা যুদ্বা একটি বিশেষ ‘কোড’ ব্যবহার করে ইংলিশদের মাঝে মিশে যেতে চাইছে। যদি ও প্রকৃত পক্ষে তাঁরা ইংলিশ নন। এই ছবিটী সত্যিকার ভাবে আমাদের সামাজ-রাস্ট্রের প্রকৃত চিত্র তোলে ধরেছে। সাম্রাজ্যবাদী দেশ সমূহে বর্তমানে কোন বিপ্লবী পরিবেশ নেই। প্রথম বিশ্বের জনসংখ্যার কোন উল্লেখ যোগ্য অংশ তা নিয়ে ভাবেন ও না । এখন এখানে যারা বিপ্লবী বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করেন তাঁরা প্রায় সকলেই হলেন বাহিরের লোক বা আঊট সাইডার।
এই ছবিটির একটি মন্দ দিক হলো – তাতে আমাদের বাস্তব দুনিয়ার সমস্যার একটি ইউটুপীয়ান বা কল্পলোকে সমাধান করার প্রয়াস নেয়া হয়েছে। রাজনৈতিক পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে সমাধানের পথে ছবির পরিচালক যাননি। গেড়িলাদের, ইস্লামিস্টদের, কমিউনিস্তদের হজবরল মার্কা আন্দোলন সংগ্রাম দিয়ে তা মোটেই সম্ভব নয়। তাঁর জন্য দরকার হলো বিপ্লবী বিজ্ঞানের ও বিজ্ঞান ভিত্তিক রাজনীতির । তাঁর জন্য প্রয়োজন হলো- অভিবাসী ও তাঁদের বন্দ্বুদেরকে সংঘটিত করা, ফ্যাসিবাদি রাস্ট্রের বিরুদ্বে প্রতিরোধ এবং মানব প্রকল্পকে এগিয়ে নেয়া। আন্দোলনের সমর্থকরা তাঁদের সন্তানকে তাঁদের অভীবাসীদের উত্থানের প্রতিক হিসাবে ব্যবহার করতে চান না । পরর্বতীতে জোসেফ ও ম্যারীর গল্পটিকে মানব প্রকল্পের প্রতি বিশ্বাসী করে তুলে। তাঁরা বিশ্বাস করতে থাকেন যে, মানব সমাজের প্রজন্ম সংক্রান্ত বন্দ্ব্যাত্ব বিষয়ক সমস্যা তাঁরা সমাধান করতে পারবেন। তাই তাঁরা রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করা, নিপীড়নের মাধ্যমে সম্পদ পুঞ্জিভুত করা এবং তা কাজে লাগিয়ে বন্দ্ব্যাত্ব সংক্রান্ত সমস্যার সমাধানে তাঁরা অধিকতর উদ্যোগী হন। এই মানব প্রকল্পের সমর্থক চক্র ধর্মভিত্তিক কর্মসূচী গ্রহন করে। তাঁরা বুঝাতে চায় এটা কোন রাজনীতির বিষয় নয়। কিন্তু বাস্তবতা হল – রাজনীতির বাহিরে কিছুই নেই।
এই ছবিটিতে প্রজনন স্বাস্থ্যের বিষয়টি নির্যাতন ও অভিবাসীদের জন্য সংগ্রামের চেয়ে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে দেখানো হয়েছে। মৌলিক ভাবে দেখলে তার সত্যতা ও রয়েছে। যদি মানুষই না থাকে তবে প্রলেটারিয়েট ও থাকবে না, বিপ্লবের ও দরকার পড়বে না। তবে এটা কতিপয় শহুরে জনবিচ্ছিন্ন বুদ্বিজিবী এটা বিশ্বাস করেন যে, যে সকল বিজ্ঞানী গোপনীয় ভাবে প্রজনন স্বাস্থ্যের বিষয়ে কাজ করছেন তাঁরা এক দিন অবশ্যই সফল হবেন। এমন কি কতিপয় গোপন চক্র ও এই সমস্যা সমাধানে সফল হবে, যাতে তেমন কোন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ও থাকবে না । দ্বীপ রাষ্ট্রের সরকার ও বিষেশজ্ঞরা এই সমস্যার সমাধানে সক্ষম হয়ে উঠবেন। তবে এটা ছবিতে পরিস্কার নয় যে রাষ্ট্র গুলো এই ধরনের কাজে আগ্রহী হবে কি না । বিজ্ঞানীদের এই আবিষ্কার অর্থহীন হয়ে উঠবে যদি তা বাস্তবায়ন না করা যায় বা না করা হয়। বরং এটা তো প্রত্যাশিত যে, যদি একটি বিপ্লবী রাষ্ট্র গঠনের ভেতর দিয়ে সকল আবিস্কার জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া যায় তবে – সকলের জন্যই কল্যানকর।
আমরা এখানে আমাদের পরিবেশ ও প্রতিবেশ সংক্রান্ত বিষয় গোলোকে একত্রে দেখতে পাচ্ছি। পরিবেশের ইস্যু গুলো আজ মানব জাতির বাচা মরার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে। তাই আজ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্বে লড়াই, সাম্যবাদের প্রতিস্টার জন্য সংগ্রাম করার পাশাপাশি সামাজিক শক্তিকে ও সকল নিগর থেকে মুক্ত রাখতে হবে, যেন সকলে মিলে একটি ঠেকসই সামাজিক ব্যবস্থা গড়ে উঠে। যদি ও প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় কোন কোন ক্ষেত্রে কিছুটা দ্বন্দ্ব সংঘাত আছে – তবে তা আমাদের পৃথিবীর মানুষের মৌলিক নীতি বা চরিত্র নয়। ছবিটিতে ফ্যাসিস্ট সরকারের কতিপয় ক্ষেত্রে ব্যর্থতা ও বিজ্ঞানিদের সফলতার কথা বলা হয়েছে। তবে বৈজ্ঞানিক চিন্তা ভাবনার পরিবর্তে পরিবেশবাদি ও নৈরাজ্যবাদিদের হৈ চৈ বেশী দেখা গেছে। তাঁরা তাঁদের আগামী দিনের ভাগ্যকে হাওয়ার উপর ছেড়ে দিয়েছে। তারা তাদের বিশ্বাস ও আস্থা সম্পুর্ণভাবে পৌরানিক ধরনের মানব প্রকল্পের উপর স্থাপন করে আছে। তাঁরা গভীর ভাবে বিশ্বাস করেন যে, সেই প্রকল্প ই তাদের বন্দ্ব্যাত্ব সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান করে দিবে। যা এই পৃথিবীকে নিরাপদ করবে। আশ্চয্যের বিষয় হলো যে, বিজ্ঞানের বিপুল উন্নতিতে ও তাঁদের চিন্তা ভাবনা গত তেমন কোন উন্নতিই হলোনা। এই ছবিটীর গল্পের পঠভুমি বিশ্বাস নিয়েই নিয়ে আবর্তিত হয়েছে। মানব প্রকল্পের জাহাজটি কোয়াসার আস্তরণ ভেদ করে সাগরের বুক থেকে ভেসে আসে। অনেকটা যেমন ইশ্বরের দরবার থেকে আগমন। ক্যা ও তাঁর শিশুকে উদ্যার করা হয় । এবং কৌতুকের সাথে বলা হয় যে, তাঁর সন্তান যেন যিশুর সন্তান। এই ছবিটি ধর্মীয় আবেস থেকে বেড়িয়ে আসতে পারে নাই ।
এই চলচ্চিত্রটি একটি ভূয়া বিষয়কে নির্বাচন করেছে। শিশুকে ব্যবহার করে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্বে এবং পৃথিবীতে মানব জাতির জন্য পরিবেশগত হোমকী মোকাবেলায় মানুষকে সঞ্চালিত করার প্রয়াস নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি একটি বিশজ্ঞ দলকে বিনিয়োগে উৎসাহ দেয়া হয়েছে – হয়ত এখন এই রূপ বিশেষজ্ঞ দলের সৃষ্টিই হয় নাই। এই ধরনের অস্পষ্ট চিন্তা ধারার কারনে ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং বুর্জোয়া শ্রেনীর মাঝে প্রতিযোগীতা তৈরী হতে পারে। অভিবাসিদের পক্ষের আন্দোলন কারীরা মনে করেন যে, তাঁদের সংগ্রামের জন্য শিশুকে ব্যবহার করার দরকার নেই। বিদ্রোহ, সংগ্রাম, লড়াই ও আন্দোলন পৃথিবীতে মানুষের ঠিকে থাকার ক্ষেত্রে উল্লেখ যোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।
আমাদের বাস্তব পৃথিবীতে – সত্যি কোন মহা নায়ক, দেবদূত বা গোপন আস্তানা নেই যেখান থেকে আমাদের এই দুনিয়াকে কোন বিশেষ ক্ষমতা দিয়ে বাঁচিয়ে দিতে পারেন। বাস্তব দুনিয়াকে কেবল বিপ্লবীরাই বাঁচাতে পারেন। বিপ্লবী বিজ্ঞান প্রয়োগের মাধ্যমে মানুষকে মুক্তি দিতে পারেন। বিপ্লবী বিজ্ঞানীরা লিডিং লাইট কমিউনিজমকে প্রয়োগ করে প্রলেতারিয়েতকে সঙ্গে নিয়ে একটি বিপ্লবী সমাজ বিনির্মান করতে পারেন; বিপ্লবী বিজ্ঞানই পারে পৃথিবীর সকল সম্পদ মানুষের কল্যানে ব্যবহার করে সামাজিক সমস্যার সমাধান,প্রকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা, স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধান এবং পরিবেশ ও প্রতিবেশ গত সমস্যার সমাধান করতে। পরিশেষে বলতে হয় – আদর্শ গত ভাবে, ‘মানব শিশু’ ছবিটি সত্যি একটি চমৎকার সিনেমা। ইহা আমাদের চলমান সমাজ ব্যবস্থার অনেক গুরুত্বপূর্ণ অসংগতি সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছে। – একে এম শিহাব