অর্থনীতিবাদে লেজুর প্রসঙ্গ

(llbangla.org)
অর্থনীতিবাদে ‘লেজুর’ আসলে  ভূলভাবে ব্যবহার করা একটি শব্দ । ‘অনুকরন বা অনুকরনবাদ’ এর আরো একটি ভ্রান্তিমূলক শব্দ। ডানপন্থী সংশোধনবাদিরা বিপ্লবী পন্থার পরিবর্তে এই জাতীয় শব্দ ব্যবহার করে থাকে। এই ভূলের প্রসারন ঘটে এই ভাবে যে, অল্প সময়ে, তাৎক্ষনিক ভাবে, ও খুব তাড়াতাড়ি সাধারণ জনগণের সুবিধা লাভের জন্য এই ব্যবস্থা গ্রহন করা। আর সকলের জন্য সূদুর প্রসারী ভাবে ব্যবস্থা গ্রহন করা ইত্যাদি। তাঁরা দির্ঘ মেয়াদী পরিবর্তনের কথা ভাবতে চান না – তাঁরা সাময়িক ভাবে উচ্চ মজুরি, রাজনৈতিক সংস্কার প্রাপ্তিতেই সন্তুষ্ট  । তাঁরা সামাজিক ও অর্থনৈতিক শ্রেনীর বিনাশ চান না । মুক্ত করতে চান না পৃথিবীকে সকল প্রকার শোষণ ও বঞ্চনা থেকে । কেবল বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র ই এই সকল ভূলের পরিসমাপ্তি টানতে পারে।লেনিন লেজুর বৃত্তি মূলক ট্রেড ইউনিয়ন পন্থীদের তিব্র সমালোচনা করেছেন। লেনিন দেখেছেন লেজুরবৃত্তি মূলক কর্মকান্ড কখনো কোন আন্দোলনকে বিপ্লবী কাজে সহয়তা করতে পারে না, তাঁরা হয়ত কিছুটা সংস্কার মূলক কাজ করতে পারেন।  ঠিক একই ভাবে লেনিন তাঁদের ও সমালোচনা করেছেন যারা মনে করেন যে, বুর্জোয়া রাষ্ট্রের কাঠামোতেই রাজনৈতিক সংস্কার, সামাজিক গণতন্ত্র, আইনী প্রক্রিয়ায় বিজয় অর্জন করে বিপ্লব করে ফেলবেন । মাওসেতুং সমালোচনা করেছেন যারা ইউনাটেড ফ্রন্ট গঠনের পর পার্টিকে বিলুপ্তি দিকে নিয়ে যেতে চায় । বিপ্লব কখনো খন্ড খন্ড ভাবে করা যায় না, খন্ড খন্ড সুবিধা দিয়ে বিপ্লবের শ্রুতধারাকে বিপথে পরিচালনা করা বুর্জোয়া শ্রেনীর কৌশল। বিপ্লব বুর্জোয়া ব্যবস্থার ভেতর থেকে সংস্কারের পথ ধরে অর্জন করা সম্ভব নয়। আলোকিত সাম্যবাদ কায়েম করা প্রচলিত বুর্জোয়া ব্যবস্থায় থেকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পদক্ষেপে সম্ভব নয়।  পুরাতন ব্যবস্থার সাথে, পুরাতন ক্ষমতা কাঠামোর সাথে কোন প্রকার আপোষ হতে পারে না । পুরাতন ব্যবস্থা আদতেই একটি নিপীড়ন মূলক ব্যবস্থা । পুরাতন ব্যবস্থাকে ঝেটিয়ে বিদায় করা একান্ত দরকার। পুরাতন ব্যবস্থার স্থলে নতুন ব্যবস্থার স্থাপন করা এখন সময়ের দাবী। পুরাতন ব্যবস্থাকে বিদায় করতে, নতুনের স্থাপনে আমাদেরকে বিজয়ী হতে হবেই। তাঁর জন্য চাই যোগ্য নেতৃত্ব, পার্টি, শৃংখলা, রাজনৈতিক লাইন এবং আলোকিত সাম্যবাদের বিজ্ঞান।

ভূল সর্বদা ই ভূল । সংগঠন যত বড় ই হোক না কেন, বা যত মানুষই সেই দলে যোগ দিন না কেন – ভুলের ফলা ফল ভুল ই হবে। বরং আলোকিত সাম্যবাদের আদর্শে তাদেরকে পরিচালিত করা দরকার। রাজনৈতিক লাইনের সকল ভূল সত্যিকার রাজনৈতিক লাইন দিয়ে সংশোধন করতে হবে, তাঁর জন্য দরকার শিক্ষা, প্রশিক্ষন ও শৃংখলা ইত্যাদি। তবে ডানপন্থীদের এই ধরনের ভূল বুর্জোয়া, পাতি বুর্জোয়া চরিত্রের সাথে সম্পৃক্ত। এই ধরনের বুর্জোয়া ও পাতি বুর্জোয়া মানসিকতার কারনেই এই ধরেন রাজনৈতিক ভুলের উৎপত্তি হয়ে থাকে। যাদের মাঝে কাপুরুষতা, ভীরুতা, শৃংখলার অভাব, উদারতাবাদ, কৃত্রিম একতার মনোভাব, এবং বড় জাত্যাভিমানীতা আছে তাঁদের মাঝে এই ধরনের ভূলের সৃষ্টি হয়। আমাদের আলোকিত সাম্যবাদ সেই সকল মানুষের দায়িত্ব নিয়ে তাঁদের ভূল ধারনা গুলো দূর করতে চায় । আমাদের অভিজ্ঞতা বলে যে, এই ধরনের মানুষেরা সাহস করে কোথা ও সত্য কথাটি পর্যন্ত বলতে পারেন না । তাঁরা কাঊকে কিছু শেখাতে ও পরিচলনা করতে পারেন না । তাঁরা  মৌলিক ভাবে নানা ভূলের মাঝে নিমজ্জিত থাকে।   তবে তাঁরা এই বিষয়টি অনেক ক্ষেত্রেই বুঝতে পারেন না। ফলে আপোষ করা তাঁদের জন্য সহজ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। মেরুদন্ডহীনতা কখনও মানুষের কাছে আকর্ষনীয় চরিত্র নয়। তাই তাঁরা আম জনতাকে আকৃষ্ট করতে ও বিপ্লবী পথে টানতে পারেন না । ফলে জনগনের দালালী করার  মানসিকতা থেকেই তৈরী হয় সংস্কারবাদের ও প্রথম বিশ্ববাদের।

একটি বিষয় লক্ষ্যনীয় যে প্রায়স দেখা যায় বাম দল গুলোর চিন্তা ভাবনা সাধারণ জনগণের ভাবনা চিন্তার স্তর থেকে অনেক এগিয়ে আছে। আবার বাম পন্থীরা নিজেদের ভাবনাকে ও জনগণের মাঝে ইতিবাচক ভাবে  গ্রহন ও করাতে  বা প্রভাবিত করতে পারছেন না । ফলে কোন কোন ক্ষেত্রে অতি বাম ধারার সৃজন হচ্ছে। যেমন – তাঁরা দাবী করছেন এখনি সব ক্ষেত্রে সমতা আনতে হবে, নেতৃত্ব বলুপ্ত করতে হবে, শৃঙ্খলা ও সংগঠনের দরকার নেই -ইত্যাদি। তাঁরা দাবী করেন বিবাহ প্রথা বাতিল করতে হবে, চলমান পারিবারিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে ফেলতে হবে। তাঁদের মাঝে আবার যারা পরিবেশবাদি তাঁরা দাবী করেবসেন যে, আগে পৃথিবী বাচাও – তাঁরা মানুষের চাহিদার কথা বিবেচনা করতে চান না – এই সব কিছু ই অতি বাম মানসিকতা। আমরা এমন কোন মেজিক জানিনা যা দিয়ে নিমিষেই দুনিয়াকে বদলে দেয়া যায়। আমরা  কেবল মাত্র ঘোষনা দিয়ে দুনিয়াকে পাল্টে ফেলতে পারিনা । একটি বেয়নেটের খুঁচায় সমাজকে বদলে দিতে পারবনা। আপনি যা খুশি তাই চাইতে পারেন, কিন্তু সত্যি দুনিয়াকে পাল্টাতে হলে মানুষ এখন যে অবস্থায় আছেন সেখান থেকেই যাত্রা করতে হবে – তাদেরকে সঠিক ধারায় পরিচালনা করতে হবে । মাও একেই গন লাইন বলেছেন।  স্থানিয়দের সাথে মিশুন, তাঁদের এই সময়কার চাহিদা গুলো বিবেচনা করে দেখুন । চাষি চায় জমি । মাও জমির ইস্যুটিকে কাজে লাগিয়ে সমাজতন্ত্র ও তা থেকে কমিউনিজমে পৌছার পথ বাতলিয়েছেন। জমি প্রাপ্তি ও মজুরী বৃদ্বিই শেষ কথা নয় । জমি, কাজ ও মজুরী বৃদ্বির বিষয়টি  গরীব মানুষকে বিপ্লবী কর্মে এগিয়ে নেবার জন্য কার্যকরী সেতু বন্দ্বন। যারা এর মধ্যেই সকল কাজকে সীমাবদ্ব করে ফেলেন তাঁরা বিপ্লবী নন। বিপ্লবী সংগঠনের আরো একটি বড় দুর্বলতা হলো তাঁরা তাঁদের কাজে অন্যদের সাথে জোট বাধার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রন বজায় রাখতে পারেন না । উদাহরন হলো – যারা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্বে কথা বলতে পারেন না – তাঁদের সাথে কাজ করা বাম বিচ্যুতি।  সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা দেশ প্রেমিক বুর্জোয় শ্রেনীর আক্রান্ত হওয়া ও তৃতীয় বিশ্বের শোষণ সম্পর্কে  কথা বলতে ভয় পাওয়া ও বাম বিচ্যুতি। আলোকি সাম্যবাদীরা অন্য কারো লেজুর হবেনা, কারো হাতের পুতুল হবে না বা ঐক্য মোর্চা গড়তে গিয়ে নিজেদের অস্থিত্বকে বিলিন করে দিবে না । আলোকিত সাম্যবাদিরা বৃহত্তর গন মোর্চায় বিশ্বাস করে। লাল পতাকাকে উর্ধ্বে তোলে ধরতে চায়। সরল ভাষায় বললে দাঁড়ায় যে, আমরা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্বে মোর্চা গঠন করব তবে নেতৃত্ব থাকবে আমাদের হাতে।  যারা আবার অতি পবিত্র থাকতে গিয়ে অন্যদের সাথে মিশতেই রাজি নন তাঁরা ও বাম বিচ্যুতির দ্বারা আক্রান্ত। অন্যান্য ভুলের মত বাম ভুল বা বিচ্যুতি ও একটি রাজনৈতিক ভুল। ভুল শোধরানোর মানসিকতা থাকতে  হবে। যদি ভুল স্বীকার করতে না  চায় – তা হবে বুর্জোয়া ও পেটি বুর্জোয়া মানসিকতার নামান্তর। নিচুতা, অধৈর্য,ইগো, মানুষের প্রতি ভালো বাসার অভাব ইত্যাদি বাম বিচ্যুতি। এই বিচ্যুতির মাত্রা বাড়তে বাড়তে এক সময় তা সংশোধনবাদের দিকে ধাবিত হয়। সংশোধনবাদের কারনে বিপ্লবীদের মাঝে কিছুই না করা প্রবনতা তৈরী হতে পারে।  তাঁরা হয়ে উঠতে পারে বদ চরিত্রের স্বার্থবাদি, অর্থহীন আড্ডাবাজ এবং প্রতিবিপ্লবী মানুষ।  আমরা জানি এবং তা আমাদেরকে সর্বদা মনে ও রাখতে হবে যে, প্রথম বিশ্ব তৃতীয় বিশ্ব থেকে সম্পুর্ন আলাদা ধরনের বিশিষ্টের অধিকারী। প্রথম বিশ্বে আদতে বিপ্লবের কোন সামাজিক ভিত্তিই নাই, সত্যিকার কোন সর্বহারা বা প্রলেতারিয়েত ও নেই । তৃতীয় বিশ্বেই কেবল বিপুল  পরিমান  দরিদ্র ও প্রলেতারিয়েত আছেন । তাই কৌশল গত কারনেই প্রথম বিশ্বের চেয়ে তৃতীয় বিশ্বে নেতৃত্বের কৌশল আলাদা হবে । তৃতীয় বিশ্বে গন লাইন এক বিরাট  ভূমিকা পালন করতে পারে। যেসকল ক্ষেত্রে প্রথম বিশ্বে মাও ও লেনিনের কৌশল এখন ও কার্যকরি সেই সকল ক্ষেত্রে  আলোকিত সাম্যবাদিদেরকে অত্যন্ত সৃজনশীল ভাবে ভূমিকা গ্রহন করতে হবে। তৃতীয় বিশ্বে আলোকিত সাম্যবাদী গন অবশ্যই বিপ্লবী সামাজিক পরিস্থিতিকে কাজে লাগাবেন। প্রথম বিশ্বের আলোকিত সাম্যবাদী নেতাগন স্বীয় অবস্থা থেকেই প্রথম বিশ্বকে মোকাবেলা করার চেষ্টা করবেন। যতক্ষন পর্যন্ত প্রথম বিশ্বে বিপ্লবের সামাজিক পরিস্থিতি তৈরী না হবে ততক্ষন পর্যন্ত – তৃতীয় বিশ্বের মত প্রথম বিশ্বে গন লাইন অনুসরণ করে কোন লাভ হবে না । যারা তৃতীয় বিশ্বের মতই প্রথম বিশ্বে ও  এখন  গন লাইন অনুসরন করেন তাঁরা মুলত প্রথম বিশ্ববাদি, সংস্কারবাদের অনুসারী, এন,জিও র লেজুর এবং বুর্জোয়াদের তাবেদার। তাঁরা সত্যিকার প্রলেতারিয়েত শ্রেনীর উপকারের জন্য কিছুই করেন না । তবে যারা সতিকারের বিপ্লব চান তাঁরা বিপ্লবাকাংখী মানুষদেরকে সামাবেশিত করতে পারেন। প্রয়োজনে অর্থ, সম্পদ ও বিপ্লবী উপকরনাদি দিয়ে তৃতীয় বিশ্বের বিপ্লবে সহায়তা করতে পারেন। আলোকিত সাম্যবাদী কমিউনিস্টগন এখন এই ধরনের কাজ কেই প্রধান্য দিতে পারেন। নিজে আলোকিত হোন ! অন্যকে আলোকিত করুন ! আমাদের দিন আসছে ! প্রথম বিশ্ববাদিদেরকে অবশ্যই ‘পরাজয়বাদ’ মেনে নিতে হবে। কেননা এটাই ইতিহাসের রায়। – একে এম শিহাব

Leave a Reply