যারজেনের বিপ্লব হলো-
তাঁর মতে, প্রাচীন কালে মানুষ ঐতিহাসিক ভাবে একটি স্বর্ন যুগে বাস করত – তাঁরা নিপিড়ন থেকে মুক্ত ছিল। এর পর তাঁরা মুল পাপে ডোকতে থাকে,প্রতিকি ভাবধারা বা ‘সংস্কৃতি’, তাদের জীবনে ক্রমে আসতে থাকে। মানুষের সাংস্কৃতিক যুদ্ব প্রচীন ইতিহাসের কোন এক সময়ে শুরু হয়েছিলো, প্রায় ৩০,০০০ হাজার বছর আগে মানুষের গুহ চিত্রের সন্ধ্যান পাওয়া গেছে। প্রায় ১০,০০০ হাজার বছর আগে, “ মানুষ ফসল ও প্রানীকে গৃহ পালিত করে তাঁদের সাংস্কৃতিক বিজয়ের সুচনা করে” সেখান থেকে মানব জাতির পতন হয় যখন বরফ যুগের সুচনা হয়, মানুষ ক্রমে প্রযুক্তির দিকে যাত্রা করে। এবং সত্যিকার অর্থে তখন থেকেই দিগন্ত রেখায় তাঁদের জন্য এক দুঃস্বপ্ন হিসাবে নানা যুগ পেরিয়ে যন্ত্র, রোবট, এবং এখন ইন্টারনেটের যুগের আভির্ভাব ঘটেছে। এগিয়েছে প্রযুক্তির ব্যবহার। “ তাঁদের প্রগতিই দৈত্য হিসাবে দেখা দিতে পারে, ব্যক্তি জীবন থেকে মানবতাবাদ বিদূরীত হতে থাকে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পরিবেশ গত মহা বিপর্যয় ডেকে আনছে। তিনি বলেন এর এক মাত্র সমাধান হলো অতীতের দিকে ফিরে যাওয়ার পথ ধরা। তিনি বলেন- ফ্রাংফোর্ট মতবাদীদের নিকট থেকে অত্র পুস্তকে অনেক কিছুই নেয়া হয়েছে। বিশেষ করে বিচ্ছিন্নতার মতবাদের ব্যাখ্যা, সময়, আর্ট ও সাংস্কৃতি ইত্যাদি। তবে, যারজেন এখানে দর্শন, নৃতত্ব,ভাষা, সাহিত্য সমালোচনাগত বৈচিত্র আনয়নের প্রয়াস পেয়েছেন। যারজেন কোন কোন সময় এমন কিছু অবাক করা অভিযোগ করেন যার প্রমান খুব কমই মিলে। যেমন – যারজেনের মতে অধুনিক দুনিয়ায় মানব জাতি অতিমানবীয় গুন ও শক্তি হারিয়ে ফেলছে ; স্বাস্থে, দৃষ্টি ভঙ্গীতে, শ্রবনে, এবং টেলিপাতি সহ বহু ক্ষেত্রে । যারজেন ও তাঁর অনুসারীদের এমন অনেক দাবী আছে যা সত্যি আপত্তিজনক। দীর্ঘ কাল পৃথীবীতে স্বাক্ষরতা, ভাষা, মৌখিক যোগাগোগ ছিলনা বলে সামাজিক বাস্তবতায় মানুষের অধিক মাত্রায় যাতায়াত করতে হত – তা যারজেন মানতে নারাজ। কৃষি ও প্রযুক্তি ছিলো না তা ও তিনি মানতে চান না। তিনি জেমস শ্রীভকে সমর্থন করে বলেন যে – নিয়ানডার্থালের সাথে প্রকৃতির ঘনিস্ট সম্পর্ক ছিলো মানষের চেয়ে বেশী। “….. আধুনিক যুগে আমরা যাদেরকে দেবতা বলে জানি তাঁরা হয়ত এক কালে এই ধরাধামেই বসবাস করত। আমাদের মাঝে বিরাজমান ছিলো পশুত্ব ও মনুষত্ব, নিয়ানডারতালদের মাঝে ও সুপ্রবৃত্তির ও কুপ্রবৃত্তির প্রবনতা ছিলো, বস্তু ও আত্মাকে তাঁরা আলাদা ভাবে না দেখে একক ভাবে দেখত, তাই তাঁরা এদের আলাদা কোন নাম ও দিত না। যা আকর্ষনীয় নয় তা তাঁরা গ্রহন ও করত না। নিয়ানডারতালরা তাঁদের গুহাকে কখন ও পশুর ছবি এঁকে সাজাত না। তবে, সম্ভবত তাঁদের জীবন যাপনে পরিশুদ্বতার কোন প্রশ্ন ও ছিলো না, তাঁরা তাঁর প্রয়োজন ও অনুভব করত না। তাঁরা তাঁদের চার পাশ্বের পরিবেশ থেকেই সুন্দরর্য্য পিপাসা মিটাত। তাঁদের কোন ডোল-ঢপকি বা হারের তৈরী বাঁশি ছিলো না, কিন্তু তাঁরা বাতাসের সুন্দর ধ্বনি, পানির কল-কল শব্দ তাঁরা শুনতে পেত, তাঁরা পৃথিবীর এবং পরস্পরেরে হৃদয়ের ধ্বনি শুনতে পেত।”
যারজেনের প্রথম বিশ্ববাদ
যদি ও যারজেন স্বীকার করেন যে কিছু মানুষ কর্তৃক অন্য মানুষদেরকে শোষনের মাঝে কিছু উপকার ও আছে- তবে তিনি নিপিড়িত ও নিপীড়নকারীদে মাঝে সীমারেখা টানায় ভুল করেছেন। তিনি লিখেছেন- “ ফ্রয়েড ভবিষ্যতবানী করেছিলেন যে, সভ্যতা যত আগাবে, মানুষের মানসিক অশান্তি তত বাড়বে। তাই আমাদের মাঝেই একটি সভ্যতা বিরোধী শক্তি ক্রমে ভেতরে ভিতরে বেড়ে উঠবে”। এই রূপ মার্কুসিয়ান মতামত, সকল মানুষকে নিপিড়নের দিকে ঠেলে দেয়, আর তা সমগ্রিক ভাবে চলতে থাকলে মানুষের মাঝে বিপ্লবের সুচনা করে, এই ধরনের প্রক্রিয়া আমাদেরকে অমানুষে পরিনত করে দিতে পারে, ফলে অনিবার্য হয়ে উঠে একটি মানবিক বিপ্লবের। তবে সেই সম্পর্কে যারজেন স্পষ্টভাবে তাঁর বক্তব্য উপস্থাপন করেন নি । সমাজের পুনর্গঠন ও পরিবর্তন সম্পর্কে প্রতিটি মানুষের মাঝে যে আগ্রহ আছে তা ও তিনি স্পষ্ট করেন নি। তবে তিনি তাঁর বিশ্বাসকে তুলে ধরেছেন।
বাস্তবতা হলো, প্রথম বিশ্ববাদি মানুষেরা এখন যে ভাবে উপকৃত হচ্ছে, যারজেনের মতানুসারে নিয়ান্ডারথালীয় জীবন যাত্রার দ্বারা তাঁরা সেই রূপ উপকৃত হতে পারবেন না । এই ধরনের প্রক্রিয়ার তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ উপকৃত হবেন, তবে যারজেনের ভাবধারায় নৈরাজ্যবাদী ধারনায় তা সুদুর পরাহত। অতীতের বিপ্লবী ইতিহাস ও মহান লেনিনের ভবিস্যৎ বানী অনুসারে বিপ্লবের কেন্দ্র হবে পুর্ব বা তৃতীয় বিশ্ব। সেখান থেকে তা পশ্চিমে প্রবাহিত হবে। তা সমগ্র বিশ্বের বিপ্লব সাধনে ভুমিকা পালন করবে। যারজেনের ভাবধারার বিপরীতে দেখা যায় যে। প্রথম বিশ্বে কোন বিপ্লব হয়নি। যা হয়েছে তা হলো – জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন । চীনে, ভিয়েতনামে, অ্যালবেনিয়ায়, করীয়ায় । প্রথম বিশ্বে একটি ও উল্লেখ করার মত বিপ্লবী ঘটনা ঘটেনি । লিডিং লাইট কমিউনিজম এ কথাটার উপর ই জোর দিচ্ছে।
পুরাতন নৈরাজ্যবাদের প্রভাব প্রথম বিশ্ববাদী ধারনাকে প্রভাবিত করাছে। তাঁরা সাম্রাজ্যবাদ ও জাতীয় স্বাধিকার আন্দোলনকে নিয়েই মত্ত আছেন। যারজেন তো প্রকাশ্যেই সাম্রাজ্যবাদের উল্লেখ করেছেন। যারজেনের সমালোচনায় নোয়াম চমস্কির কথা ও উঠে এসেছে। যার খোলাখোলী ভাবেই চমস্কির সমালোচনা ও তাঁর সাম্রাজ্যবাদের বরুদ্বে অবস্থানকে নিন্দাবাদ করেছেন। তিনি তৃতীয় বিশ্বের বিরুদ্বে যে সাম্রাজ্যবাদের লড়াই চলছে তা তিনি তাঁর লিখায় তুলে ধরেছেন।
“ মজার ব্যাপার হলো, দেশের প্রধান যখন বলেন যে এখন যা হচ্ছে তা হোল ‘সভ্যতার দ্বন্দ্ব’ – তা কি করে বলেন তিনি,আর কি পরিবর্তন চান তিনি ? তাঁর শাসনে সভ্যতার কোন উচ্চতর উদাহরন সৃষ্টি করতে পারেন নি বরং বার বার ই আমেরিকাকে একটি পুঁজিবাদী দেশ হিসাবে প্রমান করেছেন। ….শুধু তাই নয় তা চলছে হাজার বছর ধরে। সভ্যতার অভিশাপ হিসাবে। এটা তো এমন এক সভ্যতা যা প্রতি নিয়ত একের বিরুদ্বে অন্য লড়াই করছে, মরছে – আগেও তা ঘটেছে , সামনে ও তাই হবে।” পুরাতন নৈরাজ্যবাদি ধারনা এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসনের বিরুদ্বে জাতীয় স্বাধিকার আন্দোলনের মাঝে সামঞ্জস্য আছে। পুরাতন নৈরাজ্যবাদি ও প্যালেস্টাইনীদের স্বাধিকার আন্দোলন প্রায় সমানই বলা যায়।
যারজেনের কাজ কর্ম দেখে আমাদের অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, তিনি তৃতীয় বিশ্বের মানুষের বিপ্লব সম্পর্কে খুব কমই আগ্রহী । সেখান কার দারিদ্রতা দুরী করনে ভুমি সংস্কার ও উন্নয়নের বিষয়ে তেমন কোন গুরুত্ব ও দেন নি। যারজেন তাঁর ভাবধারায় বা মতবাদে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে বাতিল করে দিয়েছেন একেবারেই। প্রাচীন নৈরাজ্যবাদিদের ধারনায় প্রযুক্তি হলো একটি শয়তানি প্রক্রিয়া । তবে তৃতীয় বিশ্বের মানুষ ও এখন এর গুরুত্ব কম বুঝেন না । তাঁরা এখন বিপ্লব ও উন্নয়ন উভয়ই প্রত্যাশা করে। প্রথম বিশ্বের এরূপ ভাব না সত্যি আমাদেরকে অবাক করে বৈ কি ।
আধুনিকতা উত্তর পরিস্থিতি ;
জন যারজেনের লিখা বই পাঠে জানা যায় যে, তিনি আধুনিকতা উত্তর পরিস্থিতির নিন্দ্বাবাদ করেছেন যাকে আমারা বুদ্বি ভিত্তিক লজ্জা বলতে পারি। যারজেন লিখেছেন,
“ আসুন আমরা আমিত্বকে বর্জন করি, বুঝার চেষ্টা করি আমাদের আসল পরিচয় কি, আমাদের দর্শন কি হওয়া উচিৎ, প্রকৃতির সাথে আমাদের সম্পর্কই কি এর কারণ ই বা কি । পক্ষান্তরে, আধুনিকতা উত্তরবাদিদের মতানুসারে প্রকাশ্য বিষয় আশয় কে বেশী গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। বাস্তবতা অনেক বদলে গেছে । পরিস্থিতি এখন আগের তুলনায় অনেক ক্ষেত্রে জঠিল হয়ে উঠেছে। পুরানো ধ্যানধারনা এখন অচল ।”
হাকিম বে সম্পর্কে জারজেন লিখেছেন-
মানুষের তৈরী পদ্বতি প্রয়োগ করতে হলে তা তাঁর জন্য পুস্তকের সহায়তা নিতেই হবে। প্রকৃতির নিয়মাবলী পুস্তক মেনে চলে না। কোন একটা রোগের কারণ হয়ত এলার্জি বলে ব্যাখ্যা করা হলে ও তা সকল সময় সঠিক না ও হতে পারে। তবে তা একটি চলমান পরীক্ষা নিরিক্ষার মাধ্যমে চুড়ান্ত সিদ্বান্তে পৌঁছাতে হয়- এটা ই উত্তর আধুনিকতার নিয়ম।
উত্তর আধুনিকতা সম্পর্কে যারজেনের কথা অনেকাংশে সত্য হলে ও ইহা পরিস্কার নয় যে তিনি তাঁর বক্তব্যকে কিভাবে প্রমান করবেন। তিনি আধু মার্ক্সবাদ, বিজ্ঞান এবং আধুনিকতা মানান কি না তা পরিস্কার করে বলেন নি ।
প্রকৃত পরিবেশবাদ
যারজেন চিন্তিত যে, প্রাকৃতিক মহা বিপর্যয় অনিবার্য।
“ একটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর পুঁজিবাদ যে ভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তা সত্যি চিন্তার বিষয়, তা আমাদের জীবন যাত্রাকে নানা ভাবে প্রভাবিত করছে। দুনিয়া থেকে হাজার হাজার প্রানি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, প্রতি বছর ৫০০০০ প্রজাতির গাছ পালা একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
তবে, জন যারজেনের এই পুস্তকটি প্রচিন নৈরাজ্যবাদের এক কল্প লোককে তুলে ধরেছে। বরং লিডিং লাইট কমিউনিজম হলো প্রকৃত পরিবেশবাদি সংস্থা । ইহা সাম্রাজ্যবাদী দেশ সমূহের দ্বারা অন্যান্য দেশকে শোষণের হাত থেকে মুক্ত করতে চায়। যা হলো আজকের প্রধান দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বের অবসান হলে আমরা অন্যান্য দ্বন্দ্বকে বিদূরিত করতে পারব। শোষক সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্বে শোষিত দেশ সমূহ কে মুক্ত করতে পারলেই – সামাজিক শক্তির বিকাশ ঘটবে। সেই বিকশিত সামাজিক শক্তি দিয়ে আমরা পরিবেশ সংক্রান্ত বিপ্লব সাধন করতে পারব। সাম্রাজ্যবাদবিরুধী আন্দোলনের সফলতা আমাদের সামনের সকল সংগ্রামের বাঁধা দূর করে দিবে। বিগত শতাব্দীতে আমরা সেই উদাহরন দেখতে পাই। তবে সফল সামাজিক বিপ্লবী শক্তি যেমন বলশেভিক বিপ্লব, মাওবাদিদের বিপ্লবী উলম্পন যাতে ফ্যাসিবাদের ও অংশগ্রহন ছিল বলে যারজেন তাঁর পুস্তকে উল্লেখ করেছেন। যারজেনের পুস্তকটিতে আলোচনায় নানা ক্ষেত্রে একপেশে দৃষ্টি ভঙ্গীর সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। বিজ্ঞান বিরোধী মনোভাবের পরিচয় মেলে। বিজ্ঞান ছাড়া মানব জাতি উল্লেখ্যযোগ্য কোন সাফল্য অর্জন করেছে বলে আমাদের যানা নেই। একে এম শিহাব।