সমূদ্র পাড়ি দিতে দক্ষ মাঝি চাই

(llbangla.org)

সাম্যবাদি লেখালেখিতে পানি একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। মাওসেতুং যখন পার্টি থেকে কিছু দিন দূরে থাকার পর আবার রাজনীতিতে ফিরে আসলেন তখন তিনি পেং নদিতে সাঁতার কাটার কথা বললেন। মাওয়ের সাঁতার কাটার কথাটি ছিলো একটি রূপক মাত্র আসলে এটা ছিলো সাংস্কৃতিক বিপ্লব। এক সময় স্ট্যালিনকে একটি ঝঞ্জা বিক্ষুদ্ব স্রোতের বিরুদ্বে সোভিয়েতি ইউনিয়নের নাবিক হিসাবে চিত্রিত করা হত। এই উদাহরনটি মাওয়ের ক্ষেত্রে ও এক নতুন মাত্রা পায়। মাওসেতুঙ্গকে ও চীনা জাহাজের “দক্ষমাঝি” হিসাবে ডাকা হতো। চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময়ে একটি অত্যন্ত জন প্রিয় গান চালু হয়েছিলো যার প্রথম কলি “ সমূদ্র পাড়ি দিতে চাই সূদক্ষ মাঝি”। এই গানের লিখকের সামনে ছিলো সাংস্কৃতিক বিপ্লব আর মাঝি ছিলেন লিন পিয়াং। ইর্ষান্নিত হয়ে জিয়াং কিং সেই সময় এক ভাষণে বলেছিলেন, না না তিনি লিন পিয়াং নন। এই কথা লিন সম্পর্কে বলা হয়নি।

এই রূপক কথাটি পরিস্কার করে দেয় যে, একটি রাজনীতির জন্য নেতৃত্ব কত গুরুত্বপূর্ন। মাও রাজনীতি ও বিপ্লবকে দেখতে সংঘবদ্ব হওয়া এগিয়ে যাওয়া আবার সংঘবদ্ব হওয়া। রাজনীতি কোন উন্মুক্ত প্রান্তর নয় যে, আপনি বাঁধাহীন ভাবে ক্রমাগত এগিয়ে যাবেন, আপনি এমন একটি নদীতে সাঁতার কাটতে এসেছেন যেখানে নানা প্রকারের স্রোত বিদ্যমান। এর তলদেশে, মাঝে ও উপরে ভিন্ন ভিন্ন রকমের স্রোত প্রবাহমান। মাওসেতুং এটাকে ইতিবাচক ভাবে দেখেছেন। সেই মহান নেতার একটি ভাষ্য হলো, “ একটি বদ্ব জলাশয় বা পুকুরের চেয়ে খারাপ আর কিছু নেই”। আসলে চীনা বা পাশ্চাত্যের ঐতিহ্যে কিন্তু এরূপ ভাবনা ছিলোনা। তবে কয়েক হাজার বছর আগে এই ধরনের ভাবনার সন্দ্ব্যান মেলে সক্রেটিস যুগের আগে হিরাক্লিটাসের আমলে। মাওসেতুং এই অবস্থাকে দ্বন্দ্ববাদের অংশ হিসাবে বিবেচনা করেছিলেন। তিনি মনে করতেন দ্বন্দ্ব ও গতিশীলতা ছাড়া দুনিয়ার পরিবর্তন করা সম্ভব নয়।

মাওসেতুং দ্বন্দ্ববাদের আলোকে চীনের পার্টির রাজনৈতিক অবস্থান বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেন, সকল সময় রাজনৈতিক ভাবে অতিডান নয় বা অতিবাম ও নয় – মধ্যপন্থা অবলম্বন করা সঠিক নয়, এটা মৃত্যু কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে । সেই রাজনৈতিক লাইনকে তিনি মাওবাদি ‘কেন্দ্র’ ও বলেন নাই। “কেন্দ্রবাদিতা” তা হোক “ডান পন্থা” “চরম ডানপন্থা”, বা “চরম বামপন্থা”। রাজনৈতিক সঠিক লাইন মানেই হলো আমাদের দৃস্টিতে “বাম পন্থা”, যা এমন একটি ইঞ্জিনের মত যা সাধারন মানুষকে সামনের দিকে টেনে নিবে। মাওবাদি রাজনৈতিক ধারায় কেবল লোক জড়ো করাই যতেস্ট নয়, তা সামগ্রীক বিপ্লবের পানে ধাবমান হওয়া চাই। পার্টি বা বিপ্লবের জাহাজকে অবশ্যই আসল লক্ষ্যের পানে পরিচালনা করতে হবে।

যদি আপনি একটি নদি পারাপার করতে চান তবে আপনি সোজাসোজি পার হতে পারবেন না। যেমন- ক কেন্দ্র থেকে খ কেন্দ্রে হুবহু পৌঁছানো সম্ভব হবে না। আপনাকে অবশ্যই নদীর স্রোতের সাথে লড়াই করতে হবে। যদি স্রোত আপনাকে খুব বেশী বামে নিয়ে যায় তবে আপনি অবশ্যই ভিন্ন স্রোতের সহায়তা নিবেন। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে রন নীতি প্রনয়নের সময় সাইলগবাদ অনুসরন করলে চলবে না । তার জন্য চাই পরিস্থিতির সঠিক বিশ্লেষণ ও বাস্তব অবস্থা নিরূপন করা । তবে, মনে রাখতে হবে সঠিক স্থানে পৌছতে হলে অবশ্যই কিছু কিছু ভূল ভ্রান্তি হতেই পারে। বহু দূরের কোন গন্তব্যে পৌছতে চাইলে, ক্রমাগত নানা পথ অতিক্রম করতে গিয়ে অনেক সময় যোগ বিয়োগ করতেই হয়। আর সেই কারনেই মাওসেতুং ও তার বিপ্লবের সার্থে ডানপন্থীদেরকে তার পক্ষে রেখেছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টি ও অনেক ডান পন্থীদল চীনের বিপ্লবে ভূমিকা রেখেছে। তিনি ডান পন্থীদের সাথে আদর্শিক ভাবে মোটেই একমত ছিলেন না কিন্তু বিপ্লবের জাহাজটিকে মহান লক্ষ্যে পৌচানোর জন্য তিনি দরকার মত ডান বাম পন্থার লোকদের সাথে সমন্বয় সাধন করেছেন। এবং সময় মত আবার ঝেড়ে ফেলেও দিয়েছেন। কিন্তু মাওসেতুং দেং জিয়াও পিং কে কেন বাদ দিলেন না এমন কি সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময়ে ও নয়। অথচ তিনি জানতেন মাওসেতুং এর চরম শত্রু ডানপন্থী সংশোধনবাদি লুই শুখী্র সাথে দেং সম্পৃক্ত। তিনি মনে করতেন তাদেরকে হাতে না রাখলে হয়ত বিপ্লবের চরম ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। একেই ভাবে তিনি কিছু কিছু লোককে দল থেকে বাদও দিয়েছেন। যেমন- লিন পিয়াং ও চেন বোধার কথা উল্লেখ করা

যায়। একেই পরিস্থিতিতে তিনি চার খলিফার সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটান। ফলে ১৯৭০ সাল থেকে মাও বাম্পন্থীদের সমালোচনার সম্মোখিন হন।

নেতৃত্বের ক্ষেত্রে মাঝিতত্ত্ব ব্যক্তিপুজাবাদের সাথে সম্পর্কিত। ইহা সামগ্রীক বিবেচনায় বিপ্লবের জন্য মোটেই বিজ্ঞান সম্মত পন্থা নয়। কিন্তু কোন মানুষের যদি ব্যাতিক্রম ধর্মী যোগ্যতা থাকে, যিনি নদী পেরোতে পারেন, যিনি ডান বামের বিশ্লেষণ করে সঠিক পন্থায় লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হন তবে আমরা তাকে বিশেষ যোগ্যতা ও প্রতিভাবান হিসাবেই দেখব। তিনি হয়তবা সাইলগবাদের মতই সোজাসুজি উদ্দেশ্য হাসিল করতে পেরেছেন।

নেতৃত্বে মাঝির ধারনা মহামানব তত্ত্বের সাথে সম্পর্কিত যা বিজ্ঞান ভিত্তিক নয়। ইহা মাওসেতুং ও লিন পিয়াংয়ের মাঝে দ্বন্দ্বের উৎপত্তি ঘটায়। যদি ও লিন পিয়াং মাওয়ের একজন অনুগত ব্যাক্তি ছিলেন, কিন্তু তার বিরুদ্বের অভিযোগ করা হয় যে তিনি মাওয়ের চিন্তা ধারার না কি বিরোধী ছিলেন। অথচ লিন পিয়াং নিজে মাওয়ের চিন্তা ধারার বিকাশ ঘটাতে চেয়েছিলেন যার প্রতিফলন ঘটে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ক্ষেত্রে । মাওসেতুং লিন পিয়াং কে তার উত্তারাধিকারী হিসাবে ঘোষনা ও করেছিলেন। মাওসেতুং কে নিয়ে এমন একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছিলো যে তিনি যেন “ বৌদ্বে” পরিণত হয়েছেন। তাকে অনেকে আদর্শিক, আধ্মাতিক নেতা হিসাবে সামনে রেখে আমলা তান্ত্রিক রাজকীয় প্রসাশন প্রতিস্টা করতে চেয়েছিলেন। সেই সময় মাওয়ের কোন কাজের ভদ্রচিত ও ঘটন মূলক সমালোচনা ও করা মহা অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হতে থাকে। যা কোন ভাবেই চৈনিক বিপ্লবের সাথে সামঞ্জস্য শীল নয়।

মাওয়ের উত্তরাধিকার নিয়োগের ক্ষেত্রে ও মঝি তত্ত্ব প্রয়োগ করা হয়। মাও যখন হো জোপেং কে উত্তারাধিকার হিসাবে নির্বাচন করেন তখন তার বিবেচনায় ছিলো যে, পেং ডান ও বামের সাথে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারবেন। তোলনা মূলক ভাবে তিনি একটু নরম প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। যদি ও মাওসেতুংয়ের জীবন শেষ প্রান্তে এসে পেং কে জন প্রিয় করার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু বাস্তবে তা হয়ে উঠেনি। পেং বাম ধারার বিপক্ষেই মূলত চলে গিয়েছিলেন। ১৯৭৬ সালে পর দেং রাজনীতির ধাক্কায় তিনি ঠিকতেই পারেন নাই।

লক্ষ্যে পৌছার জন্য ভিন্ন একটি নক্সা আছে যা ব্যাক্তি কেন্দ্রিক নয়। এই নক্সায় কেন্দ্রে থাকে আসল লক্ষ্য অর্জন করা ডান বামের কেউ পরোয়া করে না । লক্ষ্যকে সামনে রেখে জনগণকে সামনে এগিয়ে নেয়া আর লক্ষ্য অর্জন করাই আসল কাজ । যখন কোন লক্ষ্য অর্জন করার জন্য স্থির করাহয়ে যায় তখন প্রযুক্তি ব্যবহার করে ও তা অর্জনের চেষ্টা করা হতে পারে। তখন যদি স্থির হয় যে ক থেকে খ এ উপনিত হব আর যদি কোন ভিন্ন রকমের স্রোত না থাকে তবে লক্ষ্যে পৌছা সহজতর হয় । কিন্তু ভিন্ন পরিস্থিতিতেই অন্য রকমের শক্তির, নীতির ও পন্থার খোঁজ করতে হয়।

আমাদেরকে বুঝতে হবে কি ধরনের আইন কানুন প্রচলিত আছে, নেতৃত্ব প্রচলিত ক্ষমতা কাঠামোতে কি ভূমিকা পালন করতে পারেন, পর্দার আড়ালে কারা কি ভাবে ভূমিকা পালন করেন। সেই বুঝে নিয়ে কি ধরনের নক্সা বা প্রকল্প গ্রহন করা যায় আমাদের কে ভাবতে হবে। আমাদেরকে সর্ব প্রথম যা ভালো করে বুঝতে হবে তা হলো ক্ষমতা শব্দটি দিয়ে কি কি বুঝায় এবং তার চর্চা কি ভাবে করতে হবে। পরবর্তী বিপ্লবের জন্য ঢেউ তোলতে হলে আমাদেরকে বুঝতে হবে আলোকিত পথ ছাড়া আলোকিত সাম্যবাদ কায়েম করা যাবে না । তাই বিগত বিপ্লবের ইতিহাস থেকে গভীর অধ্যয়ন করে আমাদেরকে শিক্ষা নিতে হবে। পুরাতন পথে পরিবর্তে নতুন পথের সন্দ্ব্যান করতে হবে। মনে রাখতে হবে কোন কিছুই সীমাবদ্ব নয়। অসীম ক্ষমতার অধিকয়ারী অফুরন্ত শক্তির আঁধার হলো আলোকিত সাম্যবাদ। ইহা একটি প্রাগ্রসর পথ ও পন্থা । জনগণ বিজয় চায়। সত্যই আসল শক্তি। আমরা সত্যি ধারন করতে পারলেই জয়ী হব।

Leave a Reply